বাঙালির দোলের দিনে পুজো হোক বা রং, মঠের উপস্থিতি আবশ্যিক। পর্তুগিজ মিষ্টি হলেও মঠ আজও বাঙালিয়ানায় পরিপূর্ণ।
কয়েক দশক আগে অব্ধি দোলের দিনে মিষ্টিমুখ মানেই তা অবশ্যই মঠ হতে হবে। সঙ্গে থাকতো ফুটকড়াই ও তার সঙ্গে সাদা মুড়কি। অতীতে দোল উৎসবে এত বেশি বাহ্যিক আড়ম্বর না থাকলেও দোল উৎসব ছিল আন্তরিকতায় ভরা।
তখন দেবতার পায়ে 'আবির' দিয়ে পরিবারের সকল বয়স্কদের পায়ে আবির মাখিয়ে শুরু হত দোল খেলা। দু'দিন ধরেই চলত সেই দোল। আর রঙ খেলার মধ্যেই আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে গোলাপি, হলুদ, সাদা রঙের মঠ। এটাই ছিল সনাতনী বাঙালির দোল খেলা।
মঠ মূলত চিনির তৈরি উঁচু শক্ত একটি মিষ্টি সেটা মোমবাতি, পাখি-সহ বিভিন্ন আকারের আর বৈচিত্রের মঠ পাওয়া যেত দোকানে চুটিয়ে রঙ খেলার ফাঁকে মুখে চালান হয়ে হত এই মঠ একটি বড় থালায় প্রচুর মঠ সাজানো থাকত আর পাশে থাকত ফুটকড়াই কালচে ভাজা মটরের ওপর চিনির আস্তরণ মুখে দিয়ে চিবলে কড়মড় করে আওয়াজ হত এও ছিল দোল খেলার সময়ের আবশ্যিক সামগ্রী তবে মঠের ইতিহাস বেশ সুপ্রাচীন দোল পূর্ণিমায় রাধামাধবের প্রসাদের থালায় বাতাসা কদমার মাঝখানে সাজানো মন্দিরের চূড়ার আকারের মিষ্টিটাই হলো মঠ যদিও এই মঠ মিষ্টান্ন বাঙালিয়ানার কৃষ্টি না হলেও বাঙালি একে আপন করে নিয়েছে তার সংস্কৃতিতে মঠ মূলত পর্তুগিজ মিঠাই হুগলির ব্যান্ডেল চার্চে প্রথম এই মিষ্টি প্রভু যিশুর প্রসাদী থালায় পাওয়া যায় পরে বাঙালি ময়রারা পরম স্নেহে মঠকে বাঙালি বানিয়ে ফেলেছেন তাকে গোলাপি, হলুদ, লাল নানান রঙে রাঙিয়ে দোলের আঙিনায় ছেড়ে দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে ফেলেছেন চিনির কড়া পাক দিয়ে সেই সান্দ্র তরল কাঠের ছাঁচে জমিয়ে বা ফুটো পাত্রের ভিতর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ফেলে এই মঠ প্রস্তুত করা হয় এটি ৫-৬ সেন্টিমিটার উঁচু একটি শুকনো ও অত্যন্ত পরিচিত মিষ্টি এই মঠ তৈরির এই ধারা আজও বর্তমান রেখেছেন হাওড়ার উনসানি শিউলি পাড়ার স্বপন মন্ডল ও তার পরিবার তারা নিজের বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন এই মঠ বাপ-ঠাকুরদার এই ব্যবসাকে সম্বল করেই চলে স্বপ্নবাবুর সংসার আগে ১৫দিন আগে থেকে দোলের মঠ প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলেও এখন ৭ দিন আগেই কাজ শুরু হয় দলের সময়ে এই মঠের চাহিদা থাকলেও সারাবছর তা থাকে না অগত্যা সংসার চালাতে দুই ধরনের বাতাসা ও সাদা মুড়কি ভরসা তবে এই বছরে সেভাবে চাহিদা নেই মঠের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুগারের ব্যাধির কারণে এই ধরণের মিষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়েছেন অনেকেই এখন শুধু পুজোর কাজেই ব্যবহার হয় এই মঠ এমনটাই জানাচ্ছেন মঠ প্রস্তুতকারী উনসানীর বাসিন্দা স্বপন মন্ডল স্বপন বাবু বলেন অধিকাংশ কারীগরেরাই এখন অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন কারণ পর্যাপ্ত কাজ না থাকায় এছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাই কারিগর পাওয়াটাও দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তিনি আরো বলেন দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি এই কাজ করছেন চিনি,গুড় দিয়েই প্রধানত তৈরি হয় মঠ তবে ৫ জন মিলে একশো কেজি বাতাস তৈরি করতে ৬ঘন্টা সময় লাগে কোভিডের আগে ব্যবসা ভালো চললেও কোভিডের পর থেকে ব্যবসা মন্দার দিকেই রয়েছে আগে ব্যবসায় অনেক লাভ করলেও এখন সেই লাভ তলানিতে এসে ঠেকেছে বলেই দাবি করেন স্বপন বাবু তবু এদিক ওদিক মিলিয়ে চালাতে হচ্ছে সংসার পাশাপাশি এই ব্যবসায় যুক্ত এক শ্রমিক প্রকাশ মোখান বলেন এখন চাহিদা সেভাবে নেই খরিদ্দারের সংখ্যাও অনেক কম কোভিডের পর মানুষের হাতে সেভাবে টাকা নেই তাই বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে দোলের দিন পুজো হোক বা আনন্দ করে রঙ খেলা সবেতেই এই সব মিষ্টির জায়গা ছিল পাকা এখন অবশ্য অনেকে জানেনও না এগুলোর কথা অথবা স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এসব খাওয়া হয় না যাই হোক বছরের একটা দিনে এটাই ছিল এক সময়ের রীতি, আনন্দ এখন সেই সব মঠ, ফুটকড়াই দেবতার প্রসাদ হয়ে কোনওক্রমে বেঁচে আছে তাও ক্রমশ অনেক পরিবার থেকেই বিলুপ্তপ্রায় তাই কোভিড পরিস্থিতি কেটে যাওয়ার পরে আবার আগের মতো চাহিদা বাড়বে কিনা এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বপন মন্ডল ও তার পরিবার যদিও আশা করেন পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হোক আবার এই ব্যবসাতে আগের মতো চাহিদা ফিরুক