সাহিত্য দর্পণ

    
প্রকাশিত হলো ‘কাব্যতরী’ সাহিত্য পত্রিকা।
...
নীহারিকা মুখার্জ্জী

নীহারিকা মুখার্জ্জী:- যাদবপুর কলকাতা:- গত কয়েক দিন ধরে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের সৌজন্যে আকাশ থাকছিল মেঘলা সঙ্গে বৃষ্টি। আবহাওয়া দপ্তরের ইঙ্গিত ছিল আরও কয়েকদিন বৃষ্টি হতে পারে। এদিকে এগিয়ে আসছে ‘মানসকন্যা’ ‘কাব্যতরী’ সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ ক্ষণ। অতিথিদের আমন্ত্রণ সহ সমস্ত আয়োজন শেষ। স্বাভাবিক ভাবেই গভীর উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছিল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তথা প্রাণপুরুষ প্রবীর চৌধুরীর। অবশেষে সব আশঙ্কা দূর করে গত ৯ ই ডিসেম্বর আন্তরিকতার মধ্যে দিয়ে যাদবপুর অন্নপূর্ণার 'বকুল দত্ত' সভাগৃহে উপস্থিত অতিথিদের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘কাব্যতরী’ সাহিত্য পত্রিকার বইমেলা সংখ্যা-২০২৪। সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় বৎসর কবিতা উৎসব। পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় সাহিত্যানুষ্ঠানের। অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রানের উচ্ছ্বাসে ও গভীর আন্তরিকতায় সাহিত্যকে ভালবেসে একে একে হাজির হন সাহিত্য প্রিয় সত্তর জন কবি-সাহিত্যিক। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে বরণ করা হয়। প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় পত্রিকার সৌজন্য সংখ্যা, মানপত্র ও একটি করে কলম। অনুষ্ঠানে ‘অনিল কুমার চৌধুরী স্মৃতি' পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন কবি মানিক দাক্ষিত এবং অসমের কবি-সাংবাদিক আসাদউদ্দিন তালুকদার ও গৌতম দাশগুপ্ত। যদিও অনিবার্য কারণবশতঃ শ্রী দাশগুপ্ত উপস্থিত থাকতে পারেননি। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রায় ষাটজন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় এক সময় অনুষ্ঠানটি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায় এবং প্রকৃত অর্থেই প্রানবন্ত ও সাহিত্যময় হয়ে ওঠে । অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি-সাহিত্যিক অজিতেশ নাগ, বৈজয়ন্ত রাহা, পিনাকী বসু, কবি-সাংবাদিক বরুণ চক্রবর্তী, সাহিত্যিক দিলীপ রায়, প্রকাশক নিগমানন্দ, কবি মানিক দাক্ষিত সহ আরও অনেক বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক। বৃষ্টির আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে সাহিত্যের টানে দূর থেকে আসা কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রবীর বাবু বলেন – আজ সত্যিই খুব আনন্দের দিন। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে সভাগৃহ পরিণত হয়েছিল মিলন মেলায়। আশাকরি আগামীদিনেও এদের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন প্রতিভাদেরও পাশে পাব।

read more
            
প্রকাশিত হলো 'জাগোদুর্গা' পুজো সংখ্যা।
...
নীহারিকা মুখার্জ্জী

সূচনা গাঙ্গুলি :- কলকাতা:-দুর্গাপুজো মানেই বন্ধুদের সঙ্গে নতুন ডিজাইনের জামাকাপড় পড়ে সেজেগুজে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়ানো, রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া দাওয়া করা, সঙ্গে একটু মস্তি। পড়াশোনার চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়ে কচিকাচাদের আনন্দ সবার চোখে পড়ে। পুজো মণ্ডপে গৃহবধূদেরও দেখা যায়। পুজোর সময় এটা খুব পরিচিত দৃশ্য। উল্টোদিকে পুজোর হাত ধরে প্রকাশিত হয় একাধিক শারদীয়া পত্রিকা। মহালয়ার অনেক আগে থেকে পত্রিকাগুলো বাজারে চলে আসে। কাব্যপ্রেমী মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকে তারই অপেক্ষায়। প্রবীণদের পাশাপাশি নবীন কবি প্রতিভাদের লেখনি কাব্য পিপাসু পাঠকের মন ভরিয়ে দেয়। তবে গত কয়েকবছর ধরে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। পাঠকের রুচি ও দামের জন্য এখন অতীতের মত চাহিদা আর দেখা যায়না। তবে তার মাঝেও কিছু পত্রিকা গোষ্ঠী আজও তার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছে। এরকম একটি পত্রিকা হলো 'জাগোদুর্গা'। মহাবঙ্গ সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত এই পত্রিকাটি গত চৌত্রিশ বছর ধরে কাব্যরসিক পাঠকের কাব্যপিপাসা মিটিয়ে চলেছে। সম্প্রতি কলকাতার অবনীন্দ্র সভাঘরে আয়োজিত এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রায় দুই শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্যনিষ্ঠ চিন্তাবিদ, সঙ্গীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের উপস্থিতিতে দেবীপক্ষে কবিপ্রণাম এবং শারদীয়া 'জাগোদুর্গা' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি তথা চিকিৎসক ডা.শ্যামল গোস্বামী, সাহিত্যিক তথা শিক্ষক সন্তোষ খাঁ, কবি ও নাট্যকার সুস্মেলী দত্ত, বাচিকশিল্পী তথা চিকিৎসক ডা. অমৃতা ভট্টাচার্য, কবি লোপামুদ্রা মুখার্জ্জী এবং মহাবঙ্গ সাহিত্য পরিষদের সভাপতি তপন সাহা সহ অন্যান্যরা। অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে যেমন কবিরা উপস্থিত হন তেমনি আসামের বেশ কয়েকজন সুপরিচিত কবি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অসমীয়া কবি রুপালী বরা সইকীয়া, দিলীপ কুমার পারোজলি ও জোনমণি বরার কবিতা পাঠ উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। সঙ্গীত, স্বরচিত কবিতা পাঠ, কাব্য সম্পর্কে মননশীল আলোচনার মধ্যে দিয়ে দুপুর ১২ থেকে রাত্রি ৯ টা পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা কীভাবে কেটে যায় টের পাওয়া যায়নি। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অমৃত ভট্টাচার্য। তার সঞ্চালনা অনুষ্ঠানটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সব মিলিয়ে এক সুন্দর অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকার সুযোগ পান উপস্থিত ব্যক্তিরা। এর আগে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক রণেন্দ্রনাথ দাস। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে গলায় উত্তরীয় পরিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। তপন বাবু বললেন - শত পরিবর্তন সত্ত্বেও আজও শারদীয়া পত্রিকা একাংশ বাঙালি পাঠককে টানে। কোনো এক অলস দুপুরে সেটাই হয় তাদের সঙ্গী। আশাকরি ভিন্ন স্বাদের কবিতা সমৃদ্ধ 'জাগোদুর্গা' পত্রিকাটি পাঠকের মনের ইচ্ছে পূরণ করবে।

read more
            
অযথা আতঙ্ক নয়- ওদের বাঁচতে দিন।
...
অদিতি গাইন

অদিতি গাইন:- বিশেষ প্রতিবেদন:- বর্ষাকাল শুরু হতে চলেছে। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বের হতে থাকবে বিভিন্ন ধরনের সাপ। এদের কোনোটা বিষধর, কোনোটা নির্বিষ। সঙ্গে বাড়বে মানুষের আতঙ্ক। সেটা স্বাভাবিক। 'সাপ' শব্দটা মাত্র দু'টো বর্ণের হলেও না চেনার জন্য অযথা আতঙ্ক গ্রাস করে আতঙ্ক। কয়েকদিন আগে সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই জনৈক ব্যক্তির আতঙ্কিত কণ্ঠ ভেসে এল। মূল বক্তব্য হলো তার বাথরুমে নাকি চারটে চন্দ্রবোড়া সাপের বাচ্চা দেখা গেছে। বাড়িতে ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আর ওদিকে সাপগুলি বাথরুমের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আতঙ্কে তিনটি বাচ্চা সাপকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও একটি সাপের বাচ্চাকে কোনো মতে বালতি চাপা দিয়ে রেখেছেন। ওনারা খুব আতঙ্কে আছেন। আমি যদি ওখানে তাড়াতাড়ি যাই খুব ভাল হয়। নিজের পড়াশোনা থাকার জন্য সাধারণত সন্ধ্যার সময় আমি কোথাও যায়না। যেহেতু বাড়ির কাছাকাছি ঘটনা তাই স্নেক ক্যাচার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও সঙ্গে আমার ভাইকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটলাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাড়ির দিকে। চন্দ্রবোড়া সাপের কথা শুনে বাবাও পিছু পিছু এলেন। সন্তর্পনে বালতি তুলে দেখি এতো lycodon aulicus ! ইংরেজিতে, Indian wolf snake বা common indian wolf snake বলে। বাংলাতে বলে ঘরচিতি সাপ। এছাড়াও গ্রামের লোকেরা একে ঘরমনি, চালবাউনি বা চাল চিতি নামেও চেনে ! এদের সাধারণত ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাওয়া যায়। লম্বায় দেড় থেকে দুই ফুট হয়। টিকটিকি, গিরগিটি, নেংটি ইঁদুর, গঙ্গাফড়িং ইত্যাদি ধরে খায়। তবে টিকটিকি খেতে এরা খুব ভালোবাসে। তাই চলে আসে গৃহস্থের বাড়িতে। দিনের বেলায় পাঁচিলের ফাটলে, ইঁটের স্তুপে, গাছের কোটরে, বাড়ির আলমারির পিছনে, ক্যালেন্ডার বা ফটোফ্রেমের পিছনে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যে হলেই বেড়িয়ে পরে খাবার খুঁজতে। এমনিতে এরা খুব ভীতু সাপ। কিন্তু খুব সতর্ক। অল্প 'থ্রেট' অনুভব করলেই তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে পালাতে চায়। পালানোর সুযোগ না পেলে রেগে গিয়ে কামড়ে দেয়। তবে কামড়ালেও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, এদের কোনো বিষ নেই। নেকড়ে বাঘের মতো ৩ থেকে ৬ টা ধারালো দাঁত আছে বলে ইংরেজিতে একে wolf snake বলে। এরা বড্ড রোগা লিকলিকে সাপ। দেখলে মনে হবে অপুষ্টিতে ভুগছে। মাথাটা কিছুটা চ্যাপ্টা। দুটি ছোট্ট ছোট্ট কালো পুঁতির মতো চোখ আছে। গায়ের রং খয়েরি, কালচে খয়েরি বা গ্রেইস ব্রাউন। গলার পিছনে অর্থাৎ ঘাড়ের কাছে হলদেটে বা হলদেটে সাদা রঙ আছে এবং ঘাড় থেকেই পর পর একটা একটা করে হলদেটে সাদা ব্যান্ড আছে কোমর পর্যন্ত। একে অনেকেই ভুল করে ভয়ংকর বিষধর কালাচ বা কালাজ সাপ ভেবে মেরে ফেলে। পিঠ থেকে একদম লেজের প্রান্ত পর্যন্ত কালাচের সাদা ব্যান্ড জোড়ায় জোড়ায় থাকে। অন্যদিকে ঘরচিতির ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত হলদেটে সাদা ব্যান্ড থাকে তাও সিঙ্গেল। এছাড়াও কালাচ কালো কুচকুচে বা নীলচে কালো হয়। কালাচের মাথাটা একটু লম্বাটে এবং লম্বায় অনেক বড়ো। যাইহোক এই বাচ্চা ঘরচিতিটাকে উদ্ধার করি। প্রতিবেশীদের অনেকেই সেখানে ভিড় করে। প্রত্যেককে বোঝাই এটা বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া নয় নিরীহ ঘরিচিতি সাপ। মানুষের উপকার ছাড়া কোনো ক্ষতি করে না। আতঙ্কিত হয়ে অযথা এদের হত্যা করবেন না। বাড়িতে সাপ বা কোনো বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়লে দূর থেকে লক্ষ্য রেখে বন বিভাগ বা জেলার সর্প উদ্ধারকারীদের সাহায্য নেওয়ার জন্য তাদের অনুরোধ করি। অবশেষে প্রকৃতির সন্তান সাপটিকে ফিরিয়ে দিই প্রকৃতির কোলে। এই পৃথিবীতে প্রাণের জন্য সৃষ্টি হয়েছে শুধু মানুষের জন্য নয় প্রত্যেকের জন্য। এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই সবার স্বার্থে Live & let live বাণী অনুসরণ করে চলতে হবে। অবলা প্রাণীদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

read more
            
প্রকাশিত হলো 'হৃদয় ও মনের কথা'।
...
সুচনা গাঙ্গুলী

সূচনা গাঙ্গুলি :- কলকাতা:- 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে' বৃষ্টির বার্তা না পাওয়া গেলেও কাব্যপ্রেমী মানুষদের মনের খোরাক মেটাতে একগুচ্ছ কবি-সাহিত্যিক ও কাব্য জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাত ধরে পাঠকের দরবারে হাজির হলো বিশিষ্ট কবি মানিক সামন্তের 'হৃদয় ও মনের কথা'। যার প্রতিটি কবিতার মধ্যে নীরবে ধরা পড়েছে প্রত্যেক মানুষের হৃদয় ও মনের কথা। এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে গত ১৭ ই জুন কলকাতার শোভাবাজার গোপীদেব রাজবাড়িতে ভিন্ন স্বাদের ১৩৫ টি কবিতা সমৃদ্ধ কবির একক সংকলন কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটিতে বেশ কিছু কবিতার সঙ্গে মানানসই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ছবির মধ্যে পল্লীগ্রামের পরিচিত দৃশ্য ধরা পড়ে যা কবিতাগুলির আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। স্বয়ং কবি ছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অনিমেষ বসাক, জাস্টিস রবীন্দ্রনাথ সামন্ত, গৌতম দেব, নিতাই মোহন চ্যাটার্জ্জী সহ আরও অনেকেই। এছাড়াও ছিলেন বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক ড. প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়, জিতেন সামন্ত, অপূর্ব বিশ্বাস, স্বপন চ্যাটার্জ্জী প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুপরিচিত ফটোগ্রাফার অরিন্দম ভট্টাচার্য সহ কবির পরিবারের সদস্য ইন্দ্রানী কোলে, মহুয়া সামন্ত, পূর্ণিমা সামন্ত, সোমা সামন্ত, কমলিকা, সৌভিক, সৌম্যজিত সহ অন্যান্যরা। রাজকীয় ভঙ্গিমায় রাজবাড়ীর সদস্য গৌতম দেবের উপস্থিতি অনুষ্ঠানের উজ্জ্বলতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কবি নিজের লেখা বই থেকে কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন। অন্যান্যরাও কবিতা পাঠ করেন। এক সময় সাহিত্য সংক্রান্ত মননশীল আলোচনা অনুষ্ঠানটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন অনিমেষ বসাক। প্রসঙ্গত কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর স্মৃতিধন্য পূর্ব বর্ধমান জেলার অনন্তপুর গ্রামে কবির জন্ম। কবি জ্ঞানেন্দ্র নাথ সামন্ত তার ডাকনাম মানিক সামন্ত নামেই বেশি জনপ্রিয়। ইতিমধ্যে তার লেখা ছোট ছোট কবিতাগুলি রসিক পাঠক সমাজের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মানিক বাবু বললেন - এমন একটা মানুষের স্মৃতিধন্য গ্রামে আমার জন্ম যেখানে সবার কলমে স্বাভাবিকভাবেই কবিতা ফুটে ওঠে। তাঁর অনুপ্রেরণা আমার পাথেয়। আমার লেখা কবিতা কাব্যরসিক পাঠকের ভাল লাগলে পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।

read more
            
কে বন্দী আর কে নয়?
...
ইন্দ্রাণী বন্দোপাধ্যায়

কে বন্দী আর কে নয়? তিহার জেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম বন্দীদের কথা। ঘরের ভেতর ঘর, তার ভেতরে, তার ভেতরে……. শেষ কোথায় কে জানে। বন্দী কে, কার কাছে, কোথায়? শুধু কি আসামীরাই কারাগারে বন্দী থাকে? তুমি আমি — আমরা মুক্ত তো? কারাগারের মানুষ গুলো বন্দী দশায় বন্দী আর কারাগারের বাইরের মানুষ গুলো বন্দী দশায় মুক্ত — কি অদ্ভুত, না? কারাগারের মানুষ গুলো মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করে আর কারাগারের বাইরের মানুষ গুলো আরও বেশি করে বন্দী হয়ে আনন্দ খুঁজে বেড়ায় — দারুন মজার ব্যাপার, না? যিনি সত্যিকারের আনন্দের সন্ধান পান — তিনিই আসলে মুক্ত, কিন্তু কি করে? জন্মজন্মান্তরে আমরা বন্দী হয়ে আসি আর যাই — একই, এক-ই ভুল না জেনেই বার বার করে চলেছি, মুক্ত হওয়ার আকাঙ্খা মনে সুপ্ত থাকে বলেই আনন্দ খুঁজে ফিরি দুয়ারে দুয়ারে। এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে সঠিক দ্বারের সন্ধান মেলে একসময়, তখন শুধুই আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ — মুক্তির আনন্দ — ……. বাধা বন্ধনহীন মুক্ত আকাশ, আলোয় আলোয় আলোকিত, এ আলোর পরশে শুধু শান্তি – শান্তি – আর শান্তি, শুধুই তৃপ্তি আর তৃপ্তি ; মন তখন সবকিছু ছেড়ে সে আলোয় ডুবে থাকতে চায়। আর যিনি এ আলোর ছোঁয়া পান, তিনি সেই আলোর পরশ সবাই কে দিতে চান নিঃস্বার্থ ভাবে, তবে এ আলোর আস্বাদ কজন নিতে পারে? কারন এ আলো বাইরের প্রাচুর্য নয়, দেয় অন্তরের প্রাচুর্য — তাই আধারটি উপযুক্ত হওয়া খুব দরকার, আর সেজন্যই তো আসল বিচারক বার বার শাস্তি দিয়ে বন্দী করেন আমাদের। যাতে ঘষে মেজে চকচকে করতে পারি নিজেদের, পরতের পর পরত সরিয়ে সেই আসল অন্তরের আলোর পথে এগিয়ে যেতে পারি, উপযুক্ত আধার হতে পারি। তাই সবরকম বন্দী জীবন ভালো, খুব ভালো — তখনই তো নিজেদের সে আলোর উপযুক্ত করে নিতে পারব। বন্দী না হলে বুঝবে কেমন করে মুক্তির আনন্দ?

read more
            
পথ হাঁটা লোকটি
...
শৈবাল মুখোপাধ্যায়

*পথ হাঁটা লোকটি* .............শৈবাল মুখোপাধ্যায়................ অমিত ভেলোর চলে গেল। সোনালি আর এষা বাড়ির দরজা থেকেই সি অফ করল। এষা ডান হাত নাড়িয়ে বলল, বাবা টাটা। অমিত রিক্সাতে বসে মুখ বাড়িয়ে হাত নাড়ল। রিক্সা চোখের আড়াল হতেই সোনালী এষাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা দিল। এষা এতক্ষণ ড্রয়িং করছিল। বাবা চলে যেতেই আবার নিজের আঁকা নিয়ে বসল। আর সোনালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সোনালির এখন অমিতকে নিয়ে ভাববার সময় নেই। তাঁর রান্না বাকি আছে। সে রান্নাঘরে ঢুকে বাকি রান্না সারতে সারতে কিছু জামা কাপড় কেঁচে নিল। কাজে কাজে বয়ে গেল আরও ঘন্টাখানেক সময়। সোনালি দেখল শ্বশুরমশাই স্নান সেরে বের হতেই শাশুড়িমা স্নানে ঢুকে গেল। এবার মেয়ের কাছে এসে দেখল এষা ঠিক ঠিক মতো আঁকছে কিনা। আঁকা মানে বইয়ের পাতায় যে সব আউটলাইন দিয়ে ছবি দেওয়া থাকে তাকেই রঙ দিয়ে ভরাট করতে হয়। পাঁচ বছরের এষার এখনও রঙের সেন্স আসে নি। সোনালি বলল, পাতার রঙ কালো নয়। সবুজ। মা এটা? না, না, পরেরটা। চটপট করে নাও। তারপর স্নান করিয়ে দেব। মা, বাবা কবে আসবে? সোনালি চোদ্দ দিনের হিসাব বুঝলেও এষা বুঝবে না। তাই সে বলল, দেরি আছে। তুমি এখন তোমার কাজটুকু সেরে নাও। আজ রবিবার বলে রক্ষে। সোনালির স্কুল ছুটি। স্কুল খোলা থাকলে কী যে হত কে জানে। সকালে একটু বাজারে যেতে বলেছিল অমিতকে। ওঁর আজ প্রাইভেট টিউশনিও ছিল না। বাজার করে ফিরতে একটু দেরি হতেই সোনালি ভাবল, আবার কার বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াল কে জানে। লোকটাকে সে তো হাড়ে হাড়ে চেনে। সকালের বাজারটা আদৌ ঘরে আসবে কিনা কে জানে! এই ভেবে অমিতের মোবাইলটা দেখতে গিয়ে দেখল সেটা যথাস্থানে রাখা আছে। এদিকে রান্নার দেরি হচ্ছে। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে অমিত ঘরে এসে বলল, আমি ভেলোর যাচ্ছি। এখন? এই সময়ে? হ্যাঁ। শিবুদার বৌয়ের একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। এখানকার ডাক্তার বলেছে অপারেশন করাতে হবে। তাই শিবুদা ঠিক করেছে অপারেশন যদি করাতেই হয় তাহলে ভেলোরে গিয়েই করাবে। শিবুদার সঙ্গে ওর শালাবাবু মানে তমালের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অফিসের একটা কাজ পড়ে যাওয়াতে সে নাকি যেতে পারবে না। এই কথা শুনে শিবুদা পাগলের মতো একে তাকে ধরে বেড়াচ্ছে। আমার কথা নাকি মনেই আসে নি। বাজারে দেখা হতেই আমার হাতদুটো চেপে ধরল। আর অমনি তুমি রাজী হয়ে গেলে? অমিত এক গাল হাসল। সোনালি জানে এখন রাগ দেখিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে থাকলেও কিছু হবে না। অমিত যাবেই। শুধু বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারলাম না। অমিত ঠাট্টা করে বলল, কী আর করবে বলো। আমার এই জীবনের সমস্ত অপরাধ তোমাকে মাথা পেতেই নিতে হবে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠল অমিত। উড়েব্বাস, নটা পনেরো। নাও, নাও, দু’একটা জামা-কাপড়, গামছা-তোয়ালে, তেল-সাবান-শ্যাম্পু, চিরুনি-সেভিং ক্রিম-ব্রাশ সব গুছিয়ে একটা ব্যাগে ভরে দাও। আমি স্নানে যাচ্ছি। অমিত বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ডাল-ভাত যা হয়েছে তাই দিয়ে দিও। দুটো পেটে ফেলে যাই। বাজারটুকু কী এসেছে? হ্যাঁ। সাইকেলের হ্যান্ডেলে রাখা আছে। সোনালির তখন পর্যন্ত ভাত ডাল ছাড়া কিছু রাধা হয় নি। সকালের জলখাবার রুটি আর আলুর চচ্চড়ি। একটা কাগজের ঠোঙাতে চারটে রুটি, ছোট প্লাসটিকের প্যাকেটে একটু তরকারি আর কয়েকটা ডিম সিদ্ধ দিয়ে দিল। একদিকে রান্নাঘরে রান্না আর অন্যদিকে অমিতের জন্য ব্যাগের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে দিতে লাগল। অমিত স্নান সেরে ফিরতেই বলল, খেতে দাও। এই বলে নিজে তৈরি হতে লাগল। এষা এসে বলল, মা আমার আঁকা হয়ে গেছে। দাঁড়াও, আগে জামা কাপড়গুলো মেলতে দিই তারপর স্নান করিয়ে দেব। সোনালি বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতেই দেখল, মেঝেতে সব ছড়ানো ছেটানো আছে। সে চটপট এষার আঁকার বই, রঙ পেনসিল বুক সেলফে রেখে এষাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মেয়েকে স্নান করিয়ে শ্বশুর শাশুড়ি আর মেয়েকে খেতে দিতেই মেয়ে বলল, মা টিভি- সোনালি টিভি অন করে মেয়ের হাতে রিমোট দিয়ে স্নানে চলে গেল। পাঁচ বছরের এষা এখন টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে ভাত খাবে ততক্ষণে সোনালিরও স্নান হয়ে যাবে। ভাত খেতে খেতে কাবেরীদেবী বললেন, ছেলেটা আর কবে বুঝবে বলতে পার? অভীকবাবু এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? এ তো আজকের ঘটনা নয়। সেই কবে থেকেই শুরু করেছিল পরের উপকার করা। একটা গুরুও পেয়েছিল। দীনবন্ধু। সত্যি সত্যিই সে দীনের বন্ধু ছিল। তার ডাক নাম দিনু। অমিত, দিনুদা বলতে অজ্ঞান। এত বছরেও যে ছেলে নিজেরটা কিছু মাত্রই বুঝল না সে কী আর বাকি জীবনে বুঝবে! বৌমার কত কষ্ট বল তো। একা হাতে এই সংসারটাকে আগলে রেখেছে। এই বয়সের কত মেয়ে স্বামী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আনন্দ ফূর্তি করে বেড়ায়, আর ও- আমাদেরকেও কেমন বোঝাত দেখতে না। সে সব ভাবলে মনে মনে একটু গর্ব হয় বইকি। ঘরের ল্যান্ড ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে। সোনালি খেতে খেতে উঠে এসে ফোনটা ধরল। হ্যালো- সোনালি, আমি হাওড়া পৌঁছে গেছি। এখান থেকে বেলা দুটো চল্লিশে ট্রেন। তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে? হ্যাঁ। তোমরা সাবধানে থেকো। এষার খেয়াল রেখো। তুমিও সাবধানে থাকবে। আমাকে নিয়ে টেনশন কোরো না। এই প্রথম ভেলোর যাচ্ছ তো- তাতে কী? আমি ঠিক সব ম্যানেজ করে নেব। ঠিক আছে। রাখছি। ফোন রেখে সোনালি খেয়ে বাসনপত্র সব রান্নাঘরে রেখে দিল। এঁটো জায়গা মুছে ঘরে এল। এষা তখনও শোয় নি। সোনালি বক্সখাটের ভিতর থেকে বালিশ বের করে বিছানা ঠিক করে মেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল। আজ থেকে সাত বছর আগে বিয়ে করেছিল অমিতকে। ভালবেসে। ভাল লেগেছিল অমিতের পরোপকারিতা, সামাজিক চেতনা, মূল্যবোধ- এসব দেখেই। তবে সোনালির তখন সেসব বোঝার বয়স হয় নি। অমিত একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। তবে পড়াশোনাতে খুব ভাল। প্রতিটি ক্লাসেই প্রথম পাঁচের মধ্যে নাম থাকত। অমিতরা আগে এই পাড়ার সামনের প্রধান সড়কের দিকে ভাড়া থাকত। পরে ওঁর বাবা জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে নেয়। খুব সুন্দর এই বাড়িটা। অমিতরা এক ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সোনালিরাও এই পাড়াতে বাড়ি বানিয়ে চলে আসে। মোড় থেকে পাড়ার ভিতরে যাওয়ার চওড়া রাস্তার উপর বাঁদিকে সোনালিদের বাড়ি। সোনালিরা যে বছর এই পাড়াতে আসে তখন সোনালি ক্লাস এইট। সেই সময় সোনালিদের বাড়ির পাশাপাশি দু তিনটে প্লট ফাঁকা পড়ে ছিল। এখন সে সব জায়গায় বাড়ি হয়ে গেছে। তখন প্রায় সবাই অচেনা, অজানা। একমাত্র স্কুলের বন্ধু ঋতুপর্ণা ছাড়া। ওরা একই ক্লাসে একই স্কুলে পড়ত। বিকালে ওদের বাড়ি যেত কখনও ঋতুপর্ণা আসত । সেই বছর সরস্বতী পুজোর সময় ঋতুপর্ণা প্রথম সংবাদটা নিয়ে এল। সোনালি নাটক করবি? নাটক! আমি! হ্যাঁ। যদি করিস আমাকে বল। আমি বলে দেব। কাকে বলে দিবি। যারা খুঁজছে। ধ্যাত, ওসব কে করবে। তাছাড়া তুই করছিস না কেন? কে বলল আমি নাটক করছি না। আমি করছি। সত্যি? এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি। এখানে সরস্বতী পুজোতে প্রতি বছর নাটক হয়। নাটক লেখে দিনুদা। নাটক পরিচালনা করে দিনুদা আর ওঁর রাইট হ্যান্ড অমিতদা। তখন পণ প্রথার উপর একটা নাটক হবে। দিনুদা একটা মেয়ে খুঁজছে। একদিন সোনালিকে দেখতে পেয়ে ঠিক করে একেই চান্স দেবে। দিনুদা আর অমিত সোনালির বাবা-মাকে সব বুঝিয়ে রাজী করাল। পাড়ার মেয়ে পাড়ার নাটকে অভিনয় করবে এতে লজ্জার কী আছে। পাড়ার বৌদিরা কাকীমা এরা অভিনয় করেন। অবশেষে সোনালি ইচ্ছে প্রকাশ করে। এভাবেই পাড়ার অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নাটক হয়ে যাবার পর একদিন অমিত বাড়ি ফিরছিল। সোনালিকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে বলল, তোমার অভিনয় অনেকের প্রশংসা পাচ্ছে। সোনালি লজ্জামিশ্রিত হাসি হাসল। তুমি রোলটা প্লে না করলে আমাদের একটু সমস্যায় পড়তে হত। ঠিক চরিত্রের জন্য সঠিক অভিনেত্রীর দরকার। বাই দ্য বাই, তোমার কোন ক্লাস? নাইন। গার্লস স্কুল? হ্যাঁ। ঠিক সেই মুহুর্তে সোনালির মা বারান্দায় এসে দেখল সোনালি অমিতের সঙ্গে কথা বলছে। একি তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন? ঘরে এস। সোনা দরজাটা খুলে দে। বাড়ির কাঠের দরজার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের দরজাও যে খুলে যাবে সেটা কী তখন সোনালি ভেবেছিল। সেই প্রথম। তারপর কত সময় বয়ে গেছে। সোনালির মা চা দিয়ে কিছু ঘরের কথা কিছু অমিতের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। এইভাবে কিছু সময় পার করে অমিত বলল, অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার উঠি। সোনালি বলল, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? সদানন্দবাবুর চোখ অপারেশন হয়েছে। একবার দেখে এলাম। সোনালি চুপচাপ শুয়ে আছে। আজ অমিত চোদ্দ পনেরো দিনের জন্য বাইরে চলে গেল। এর আগে যে যায় নি তা নয়, গিয়েছে তবে সেটা কয়েকদিনের জন্য বা পাড়ার বাইরে। আর আজ সে রাজ্য ছাড়া। কত কথা চোখের সামনে ভেসে আসছে। কত মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ, সংসার এবং সাংসারিক দ্বন্দ্ব- সবই হয়েছে। মিটেও গেছে। সোনালির মন আজ ভারাক্রান্ত। কত বিক্ষিপ্ত স্মৃতি তাঁর মনের কোণে ঘোরাফেরা করছে। তখন বর্ষাকাল। একটানা তিন চারদিন বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কাচা ড্রেন জলে ভরে রাস্তায়। পরে সেটাও ডুবে বাড়ির উঠোন ভরিয়ে দিচ্ছে। দিনুদা পাড়ার এক দঙ্গল ছেলেকে জুটিয়ে মাথায় প্লাসটিক জড়িয়ে নেমে পড়ল কাজে। এর ওর বাড়ি থেকে কোদাল জোগার করে পাড়ার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সরু সরু ড্রেন কেটে জল যাবার ব্যবস্থা করে দিতেই জল বাধনহারা উল্লাসে মাঠের দিকে বয়ে গেল। ড্রেনের মধ্যে ভেসে থাকা নানা ধরনের নোংরা পদার্থ কোদাল দিয়ে তুলে ঝুড়ি করে দূরে ফেলে দিল। সোনালিদের এদিকেও একই অবস্থা। দিনুদা এবং ওঁর দল সেখানে পৌঁছে গেল। দিনুদা নির্দেশ দিতেই গোটা পাঁচেক ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সোনালি বারান্দায় বসে দেখছে। কেউ কেউ বিশ্রাম নেবার জন্য বসে গেলেও অমিতের কোনও বিশ্রাম নেই। জোরে জোরে কোদাল চালিয়ে মাটিগুলো এক জায়গায় রেখে ড্রেন বানাচ্ছে। জল বের হচ্ছে হু হু করে। কখনও কাচা ড্রেনের মুখ ছাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুরে ঘুরে সরোজমিনে দেখছে কোথাও কিছু আটকে আছে কিনা। থাকলে কোদাল দিয়ে ছাড়িয়ে দিচ্ছে। এই পাড়ারই একটি ছেলে দেবু এসে বলল, সোনালি একটু জল দাও তো। সোনালি ভিতর থেকে একটা বিস্কুটের কোটো আর জল নিয়ে এসে বলল, আগে বিস্কুট খাও। সবাই যে যার কাজ ফেলে হাতে হাতে বিস্কুট তুলে নিতেই দেখল কোটো ফাঁকা। অবশেষে অমিত এসে দেখল বিস্কুট নেই। সোনালি হেসে বলল, ঘরে আছে। এনে দিচ্ছি। না, না, শুধু জলেই হবে। তা কেন। সবাই পেয়েছে। সোনালি বিস্কুট নিয়ে এসে বলল, তোমরা বসো। মা চা বানাচ্ছে। এই কথা শুনে দেবু, রানা, প্রশান্ত- সবাই চেচিয়ে উঠল- থ্রি চিয়ার্স ফর কাকিমা--- হিপ হিপ হুররে। পরদিন ভোর হওয়ার আগেই বৃষ্টি থেমে গেছে। সকালে চকচকে রোদ। রাস্তায় আর কোথাও জল জমে নেই শুধু কাদা ছাড়া। এর ঠিক দু তিনদিন পরে রাস্তার মোড়ে ট্রাকটরে করে ভাঙা রাবিশ এসে জমা হতে লাগল। এগুলো কাদের, কোথা থেকে আনা হচ্ছে কেউ জানে না। রবিবার দিনুদার দল ঝুড়ি কোদাল নিয়ে সরাসরি ফিল্ডে। রাবিশগুলো রাস্তার নীচু জায়গায় ফেলা হচ্ছে। বড় বড় ইটের টুকরো, সিমেন্টের দলা- শাবলের পিছন দিক দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। এভাবেই চলাচলের রাস্তা ঠিক করা হল। একদিন সোনালি জিজ্ঞাসা করল, এই রাবিশগুলো কোথায় পেলে? ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখলাম পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ওখানে ফ্ল্যাট হবে। রাবিশগুলো পড়ে আছে। ওদের বলতেই ওরা দিয়ে দিল। সেটা নিয়ে এসে রাস্তায় ফেলে দিলাম। একজনের ফেলে দেওয়া জিনিস আমাদের পাড়ার উপকারে লাগল। মাধ্যমিক পাশ করল সোনালি। অমিতকে ডেকে মিস্টি খাওয়াল। তোমার কোন সাবজেক্ট ভাল লাগে? ইংরাজী। ওটা তো আমারও প্রিয় সাবজেক্ট। ইংরাজী নিয়ে অনার্স করছি। সোনালির মা চা দিতে এসে বললেন, তাহলে খুব ভাল হল বাবা। যদি সোনাকে একটু দেখিয়ে দাও। নিশ্চয়ই দেব। অমিতের প্রতি একটা টান অনুভব করছে সোনালি। গত দুদিন ধরে সে অমিতকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় গেল কোনও খবর নেই। একবার ভেবেছিল অমিতদের বাড়িতে গিয়ে ওঁর বোন শোভনার কাছ থেকে জেনে আসবে। সেই ভাবনা নিয়ে বের হয়েছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর ভাবনার পাশাপাশি আর একটা ভাবনা এসে ধাক্কা মারল। যদি শোভনা কিছু বুঝতে পারে। কারণ শোভনা সোনালির থেকে এক দেড় বছরের বড়। শোভনা যদি ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, অমিতের সঙ্গে কী দরকার। অমিতের বাবা মা যদি সন্দেহ করেন- তাহলে ব্যাপারটা লজ্জার হয়ে যাবে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই সোনালি চলে এল। চারদিনের দিন বিকালে অমিতের সঙ্গে দেখা। অমিত সোনালিকে দেখে হাসল। সোনালি হাসল না। কোনও কথা বলল না। একটা অন্যরকম মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকল। অমিত আর একটু কাছে এসে বলল- কিছু বলবে মনে হচ্ছে। কয়েকদিন না দেখার অভিমান উগড়ে দিল সোনালি। কোথায় ছিলে তিনদিন? আমাদের বেড়ানোর কোনও জায়গা নেই সোনালি। এই ক’দিন হাসপাতালেই ছিলাম। সেখানেই থাক আর দুনিয়ার লোকের সেবা করে যাও। আমাদের তো এটাই ব্রত। তাহলে খাওয়া দাওয়া- হোটেলেই সেরে ফেলেছি। তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। থাক ওসব কথা। এবার নিজের কথা বল। ইংরাজী দেখিয়ে দিতে হবে? তখনও অভিমান কমে নি সোনালির। সে মুখ বেঁকিয়ে বলল, থাক। আমার কথা না ভাবলেও চলবে। অমিত দেখল সোনালির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। শোনো না। মিনিট দশেক আগে বাড়ি ফিরেছি। জামা-প্যান্ট ছেড়েই বেরিয়ে এলাম। বল কী বলবে। সোনালি মনে মনে বলল, ন্যাকা। কিছু বোঝে না যেন। হু, এই বলে সোনালি একটুখানি জিভের ডগা বের করে ভেঙিয়ে চলে গেল। সোনালির চলে যাওয়া দেখে অমিত হাসতে লাগল। একদিন হন্তদন্ত হয়ে সোনালিদের বাড়িতে এসে বলল, সোনালি, তোমাদের টেলিফোনটা একটু ইউজ করতে পারি? তোমাকে না বলেছি। আহঃ, হ্যাঁ কি না সেটা বল। না। উত্তর শুনেই অমিত চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে থাকে। কী হল ফোন করবে না? তুমি যে বললে- সোনালি হাত ইশারা করে দেখিয়ে দিল। অমিত ফোনের কাছে যেতে যেতে বলল, ঘটনার গুরুত্ব না বুঝে ঠাট্টা করবে না- এই বলে অমিত পকেট থেকে একটা ছোট্ট ডায়রি বের করে নম্বর ডায়াল করল। হ্যালো দীনেশ-। ফোন কেটে আবার অন্য একটা নম্বর ডায়াল করল। হ্যালো জীতু-। আবার অন্য একটা নম্বর। অলোক আছে। ভাই তোমার কি বি পজেটিভ? অমিত ফোন কেটে আবার ডায়াল করল। সোনালি সোফাতে বসে দেখতে থাকে। দেখতে থাকে অমিতের চোখ মুখের অবস্থা। মনে হচ্ছে যা চাইছে সেটা ওরই দরকার। কার্তিক তোমার বি পজেটিভ? বাহ। তুমি এখনই হাসপাতালে চলে যাও। গাইনো বিভাগ। বেড নম্বর বারো। যাবে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও যাচ্ছি। বেশি দেরি কোরো না। দেরি হলে বিপদ হতে পারে। অমিত ফোন নামিয়ে হাঁপাতে থাকে। সোনালিকে দেখতে পেয়ে বলল, একটু জল দাও। ওই দেখ টেবিলে রাখা আছে। অমিত জগ থেকে ঢকঢক করে জল খেল বেশ খানিক। তারপর একটা দম ছেড়ে বলল, থ্যাঙ্কস। কার্তিককে পেয়ে এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে বসতে পারল অমিত। সোনালি বলল, একটু বস চা আনছি। একটু পর সোনালি ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। একটা প্লেট ধরিয়ে দিল অমিতের হাতে। কুচো নিমকি সহযোগে চা। কী হল? তুমি দাঁড়িয়ে আছে কেন? বস। গতকাল থেকে বাড়ির ফোনটা ডেড হয়ে আছে। অফিসে কমপ্লেন করিয়েছি। এখনও ঠিক করল না। ওরা ওদের মর্জি মতো আসবে। তাহলে হল। ততক্ষণে পেশেন্ট ভোকাট্টা। সেকি! আতকে ওঠে সোনালি। অমিত গোফের ফাঁকে মুচকি হাসে। সেই দেখে সোনালি বলল, যাঃ, তোমার মুখে যত আজেবাজে কথা। হাসলাম বলে বাজে না হাসলে- তবে পেশেন্টের অবস্থা সিরিয়াস। ডাক্তার বলেছে দু তিন বোতল রক্ত জোগার করে রাখতে। এক বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছে। এক বোতল রক্ত হাতে । যদি লাগে তাই আর এক বোতল রক্তের ব্যবস্থা করে রাখলাম। কী এমন কেস? ডেলিভারী। তবে পেশেন্টের কন্ডিশন খুব খারাপ। শরীরে রক্ত নেই। অথচ সিজার করতে হবে। এই সময় মেয়েদের শরীর উইক থাকে। একটু ভালমন্দ খাওয়াতে পারে নি? কে খাওয়াবে সোনালি? যে খাওয়াবে সে একজন রিক্সাওয়ালা। সোনালি অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। অমিত, দিনুদা এরা কাদের পাশে থাকে। যারা কর্পদকশূন্য! যারা দু’বেলা দু’মুঠো খাবার খেতে পায় না। তাদের পাশে এরা থাকে। ভাবতে ভাবতে কথাটা বলে ফেলল। তোমরা এদের পাশে থাক? এদেরই তো পাশে থাকা দরকার। বড়লোকদের অর্থ আছে। তারাও কিন্তু রাতে পেশেন্টের পাশে থাকার মতো কোনও আত্মীয়কে পায় না। ওরা কোনও এন জি ও থেকে টাকার বিনিময়ে লোক ভাড়া করে। তবে কী জান সোনালি, ওই সমস্ত মেকি বড়লোকদেরও দেখেছি ওদের হৃদয় বা মানবিকতা বলে কিছু নেই। রাত্রে জেগেছি। রেস্টুরেন্ট থেকে ভাল খাবার এনে খাইয়েছে। কাজ ফুরিয়েছে চলে গিয়েছে। না ধন্যবাদ। না কোনও আপ্যায়ন। তাহলে এবার থেকে ওই ধরণের লোক ডাকলে যাবে না। তা হয় না সোনালি। সেবা করার ব্রত যখন নিয়েছি সেবা করা বা সেবা দেওয়াটাই আমাদের কর্তব্য। এখানে গরিব বড়লোক নেই, হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান নেই। আমাদের চোখে রক্ত মাংসে গড়া দেহটাই আপন । যাকে আমরা বলি মানুষ। বাকি সব তুচ্ছ জঞ্জাল। সোনালি অমিতদের ভাবনা চিন্তা দেখে অবাক হয়ে যায়। এরা কত গভীরভাবে সমাজের কথা চিন্তা করে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কথায় বলে- দুখীর পাশে দাঁড়াও, এর থেকে বড় আনন্দ আর কিছুতে নেই। সত্যি, সোনালি মাদার টেরেজাকে দেখে নি, দেখে নি ভগিনী নিবেদিতাকে, দেখে নি নেতাজীকে- আজ স্বচক্ষে দেখছে অমিতকে, দিনুদাকে। সোনালি প্রশ্ন করল- আর্তের সেবা করব- এই মনোভাব কোথা থেকে এল। কেন দিনুদা। এই পাড়া। কত লোকের বাস। সারা বছর কারও না কারও কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। আমরা খবর পেলেই ছুটে যাই। পাশে গিয়ে দাঁড়াই। আবার পাশাপাশি বছরে সবাইকে নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। দিনুদার লেখা নাটক। বর্ষাকালে পাড়ার রাস্তা ডুবে যায়। হাঁটা যায় না। তখন ঝুড়ি কোদাল নিয়ে নেমে পড়ি। এভাবেই ধীরে ধীরে আনন্দ এসেছে মনে। সেই কবে থেকে শুরু করেছি। সোনালির মুখে কথা নেই। সে হা করে অমিতের কথা শুনছে। জান, দিনুদা ডাক্তার না হয়েও ইনজেকশন দিতে পারে। প্রেসার দেখতে জানে। কাটাছেঁড়ায় ছোটখাটো সেলাই করে দিতে পারে আবার শুকিয়ে গেলে কেটে দিতেও জানে। এইটুকু করে দিলে কত গরিব মানুষের উপকার হয় বল তো। সোনালি একটা হালকা কথা বলে ফেলল। বিনিময়ে- সোনালির বোকা প্রশ্ন শুনে অমিত বলল, আর্তের সেবা করা। এখানে বিনিময় দেখে না। তারা ওইটুকু করেই আনন্দ পায়। আর যাদের করে তারা হয় উপকৃত। এটাই দিনুদার লক্ষ্য। দিনুদা রেডক্রশ থেকে ফাস্ট এইড এর ট্রেনিং করেছে। ও একজন রেডক্রশের সদস্য। দেখ না সারাদিন কোথায় কোথায় ছুটে চলেছে। ওঁর কাজ শুধু আমাদের পাড়া ঘিরে নয়। এখন পাড়াটা মূলতঃ আমি দেখি। তবে দিনুদা মনে করলে আমাকে নিয়ে যায়। জানো, আমি পিজিতে গিয়েও রাত কাটিয়েছি। তিনদিন ছিলাম তবে রোগী বাঁচে নি। বেশ। এবার তোমার কথা রেখে আমার কথা মন দিয়ে শোন। ইংরাজী দেখিয়ে দিতে হবে তো? যাও বই নিয়ে এসো। মা বলেছে তোমাকে পড়াতে হবে। এসে দেখিয়ে দিলে চলবে না। প্রাইভেট টিউশনি। সেই থেকে শুরু হল অমিতের প্রাইভেট পড়ানো। তারপর পাড়ার আরও কয়েকজন এসে ধরল। খুব সুন্দর পড়ায় অমিত। সোনালির মনে ধরে গেল। তবে হঠাৎ হঠাৎ ডুব দিয়ে দেয়। অমিত ফিরে এল জানতে পারে- কার রক্ত লাগবে ডোনার খুঁজে বেড়ানো। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না, চাঁদা তোলা। কোনও রোগীর বাড়ির লোকের অভাব, যাও রাত জাগো। যেখানে কেউ নেই সেখানেই অমিত গিয়ে হাজির। দু একজন বন্ধু নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। এই সবের মাঝেও প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা- এসব থেকেই ক্রমশ সোনালি দুর্বল হয়ে পড়ছে অমিতের প্রতি। সোনালি ভেবে পায় না অমিত কী কিছু বুঝতে পারে না, নাকি অমিত তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক চিন্তা করে সোনালী ভেবে দেখেছে- অমিত এড়িয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। ঠাট্টা করে সোনালি এমন কথা কিছু বলল, তার গুরুত্ব দিল না অমিত। হাত নাড়িয়ে বলে- ধুস। কিন্তু সোনালি? সোনালির মনের ভিতর যে প্রেমিকা সুলভ মনোভাব লুকিয়ে আছে অমিতকে বোঝাবে কীভাবে। কীভাবে জানাবে। ঘরের মধ্যে মা থাকে। বাবা থাকে। যদিও সোনালির মা-বাবা অমিতের মধ্যে সেরকম কিছু দেখে নি বলেই তারাও অনেক ক্যাজুয়াল। এভাবে দিন দিন সোনালি পথ বের করার চেষ্টা করতে লাগল। একদিন সুযোগ পেয়ে যায়। ফোন করে অমিতের বাড়িতে। হ্যালো অমিত বলছি- সোনালি একটু সময় নেয়। তারপর খুব ধীরে ধীরে চাপাস্বরে বলল- আজ বিকেল পাঁচটার সময় এগ্রিকালচার হস্টেলের মাঠে চালে এসো। কথা আছে। এইটুকু বলেই ফোন নামিয়ে দিল সোনালি। ফোন নামিয়ে দিতেই ওঁর খেয়াল হল, আজ বিকেলে থাকবে তো। যদি এখনই কোথায় বেরিয়ে যায়। আবার ফোন করবে। জেনে নেবে। না থাক। ওঁর কাছ থেকে যদি ফোন আসে এই ভাবনায় সোনালি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। অমিতের সঙ্গে গোপন সাক্ষাৎ হল হস্টেলের মাঠে। এই প্রথম। এতদিন সোনালি যার সঙ্গে কত সহজভাবে কথা বলে এসেছে, সেই সোনালিই এখন ভয়ে, একা একা বাড়ির বাইরে এসে প্রেমের গোপনীয়তায় লজ্জায় যেন রাঙা হয়ে উঠেছে। সে অমিতকে দেখছে কিন্তু আজ এই উন্মুক্ত বৈকালিক পরিবেশে সোনালির ঠোঁট আটকে গিয়েছে। কথা বলতে পারছে না। অমিতওবা কীরকম! ও কী বুঝতে পারছে না। সোনালির অন্তরের হাহাকার। ও তো প্রথম কথা বলতে পারে। ওর প্রশ্ন সোনালির উত্তর। এভাবেই সোনালি সহজ হয়ে যেত। আমরা কি এভাবেই বসে থাকব? বাধ্য হয়ে বলল সোনালি। আমিও সেই কথা ভাবছিলাম। কী এমন গোপন কথা। যার জন্য এই হস্টেলের মাঠে ডেকে আনলে। ন্যাকা। বোঝে না যেন। মনে মনে আওড়ালো সোনালি। অমিতের কোনও কৌতূহল দেখতে পাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে আড় চোখে অমিতকে দেখছে। অমিত কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেরা ফুটবল খেলছে। ইসস, পাশটা ওই ছেলেটাকে বাড়িয়ে দিলেই গোল হয়ে যেত। সোনালি উদাস চোখে পশ্চিমাকাশে তাকায়। সূর্য আকাশের অন্তরে লুকিয়ে গিয়েছে। আগামীকাল পূর্বদিকে তাকে দেখা যাবে। পরিষ্কার আকাশ। দূরে, বহুদূরে হালকা নীল মেঘ ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাখি দেখা যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে বাসার দিকে। সোনালির চিন্তার জালে হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন এসে আটকে গেল। অমিত, নানা লোকের নানা কাজে উপস্থিত হয়। ফলে পাড়ার বাইরেও অনেক পরিচিতি। এছাড়াও সে কলেজে পড়া ছাত্র। কলেজের কোনও বান্ধবীকে কি সে ভালবাসে? বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। সোনালির ভাবনা এটাও তো হতে পারে। কিন্তু অমিতের মুখ থেকে কখনও কোনও মেয়ের কথা, কলেজের ছোটখাটো ঠাট্টা ইয়ার্কির কথা শোনে নি। তাহলে কী সত্যি সত্যিই ওঁর কোনও অ্যাফেয়ার আছে? যদি থাকে- পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামে। ছেলের দল বাড়ি ফিরে যায়। দূরের স্ট্রিটল্যাম্প জ্বলে উঠেছে। প্রকৃতির আলো ধীরে ধীরে আবছা হচ্ছে। দূরের রাস্তায় একটা ছেলে একটা মেয়েকে সাইকেলে বসিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছে। অমিত বলল, চল, এবার উঠি। সোনালি একটু বেপরোয়া হয়ে উঠল। যে ছেলের প্রেম বিষয়ে বোধ কম তাকে একটু বোঝাতেই হয়। সোনালি ডান হাত উচু করে বলল, আমাকে টেনে তোল। অমিত সোনালিকে তুলে ধরতেই সোনালি পায়ের উপর ভর দিয়ে অমিতের বুকের উপর ঝুকে ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে বলল, আই লাভ ইউ। প্রায়ান্ধকার প্রাকৃতিক পরিবেশে অমিত সোনালির চোখের উপর চোখ রেখে বলল, আই লাভ ইউ টু। এরপর পড়ানোর বাইরে চলল ওদের মেলামেশা। সোনালি অমিতকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। পড়াতে এসে ফিরে যাওয়ার সময় বলে। কখনও অমিত দেখা করে। আবার কখনও অমিত আসে না। সোনালি একা একা হস্টেলের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যান্য ছেলেরা যারা বৈকালিক ভ্রমণে বের হয় সোনালিকে দেখে টোন টিটকারি করে। একা কেন? যাব নাকি। শ্যাম আসে নি। রাধার কী হইল অন্তরে ব্যথা। এইরকম আরও কত কিছু। সোনালি পাত্তা দেয় না। সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অমিতের উপর রাগ হয়। অবশেষে একা একাই ফিরে আসে। পরে অমিত পড়াতে এলে, চাপা গলায় শুনতে চায়- গতকাল না আসার কারণ জানতে পারি কী। গতকাল তিনটে স্কুলছাত্র দামোদর নদে পড়ে গিয়েছিল। একজনকে সঙ্গে সঙ্গে তোলা গেছে। আর একজন হাসপাতালে ভর্তি। বাকিজনের কোনও ট্রেস পাওয়া যায় নি। সেখানেই গিয়েছিলাম। শুধু সেই দিনই নয়। এই রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। কখনও এসে বলত, ব্ল্যাড ডোনেশন ক্যাম্পে ছিলাম। কোন ছাত্রকে র্যা গিং করা হয়েছে। সে অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এই রকম কত সমস্যা আর সেখানে এদের উপস্থিতি। শুনতে শুনতে সোনালির রাগ হত। কথা দিয়ে যে আসতে পারে না তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। কথা বলবে না। পড়াতে এলে বলে দেবে, তোমার কাছে আর পড়ব না। কী কী কথা বলে অমিতকে অপমান করবে সব কথা ভাবতে থাকে পড়তে বসে। তবে সাময়িক। অমিত এলে ছুটে যায় দরজা খুলতে। মুখ দেখেই সমস্ত মান অভিমান জল হয়ে যায়। পড়ার বিষয়ে খুব সিরিয়াস। একঘন্টার মধ্যে শিখিয়ে দেবে। সোনালির ভাবনার বেলুন ফেটে যেত অমিতের গতকালের ঘটনা শুনে। সোনালি ধীরে ধীরে ব্যাপারটাকে রিয়েলাইজ করার চেষ্টা করত। অমিত বলেই দিয়েছে সে একা নয়। সে সবার জন্য। সেক্ষেত্রে সোনালিও সেই বহুর মধ্যে একজন । তবে সোনালির হৃদয়ে অমিত। যে বহুলোকের জন্য কাজ করে তাকে এভাবে হিংসুটের মত নিজের বুকে বেঁধে রাখা ঠিক নয়। এসব ভাবতে ভাবতে সোনালির চোখ জলে ভিজে যায়। আজ অমিতের জন্য একটু হলেও প্রচ্ছন্ন গর্ব হয় সোনালির। কালের নিয়ম মেনে কত লোক কত মানুষ নিজেদের বিচার বুদ্ধি লোপ করে ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যে বাবা মা ছোট থেকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করে, নিজেদের কেরিয়ার গড়ার জন্য সেই বাবা মাকে ফেলে কোথায় কোন সুদূরে চলে যায়। এখন ইলেকট্রনিক্সের যুগে দূর থেকে শুধু মোবাইলে কথা হয়। বাবা মাকে দেখা, বৃদ্ধ বয়সে সেবা করা- কোনটাই আজ আর বেচেবর্তে নেই। বাইরে থাকছে আর লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করছে। সেরকম হলে এই মফস্বলের বাড়ি বিক্রি করে বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে মনে করে কত বড় নৈতিক দায়িত্ব পালন করল। অমিত আজ রাত্রিটা ট্রেনেই কাটাবে। ঘড়ি দেখল সোনালি। রাত্রি দশটা পাঁচ। একবার ফোন করা দরকার। তবে অমিত দুবার ফোন করেছিল। যখন করমন্ডল এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিল। পরে আর একবার। সোনালি ফোন করল। কুক কুক কুক- নট রিচেবেল। এই হয়েছে এক মোবাইল কোম্পানী। অ্যাডের বেলায় পাহাড় থেকে পাতাল, ঘর থেকে গুহা- সবেতেই কানেকশন অথচ বাস্তবে সে সবের ধারে কাছেই ঘেষে না। সোনালি ফোন রেখে ঘরে আসে। এষা ঘুমিয়ে গিয়েছে। একটু ওঠ মা। বিছানা করে দিই। একটু সর। এষা ঘুম চোখে ঢলে। তাকে পাশে রেখে সোনালি বিছানা ঠিক করে জায়গামতো শুইয়ে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে এসে বলল, মশারি টাঙিয়ে দেব? না। খুব গরম। তুমি বরং মশার অয়েল জ্বালিয়ে দাও। সোনালি মশার অয়েল জ্বালিয়ে টেবিলে জলের বোতল দিয়ে টর্চ রেখে দরজা ভেজিয়ে দিল। অভীকবাবু বললেন, যাও, এবার শুয়ে পড়। আগামীকাল তোমার স্কুল আছে। সোনালি নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। অমিতের চিন্তায়, নিজের জীবনের ভাবনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঘুম ফিরে যাচ্ছে। জীবন নদীর ঢেউয়ের মতো। কখনও জোয়ার কখনও ভাটা। কখনও ঢেউ ওঠে কখনও ঢেউ ভাঙে। সোনালির বিয়ে নিয়ে বাবা মায়ের অমত । ফলে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে সোনালিকে একা লড়াই করতে হয়েছে। ও রকম করিস না সোনা। তুই একটু বোঝবার চেস্টা কর। বললেন সুরমাদেবী। মা, আমি সবকিছু বুঝেই তোমাদের বলেছি। তোমরা যদি না মান তাহলে আমি কী করতে পারি। তোর কী এটা বোঝার বয়স? স্নেহকন্ঠে বললেন দেবেনবাবু। কেন নয়? এই তো কলেজ শেষ করলাম। ও, কলেজ শেষ করলেই বুঝি সবকিছু বুঝে যায়। তাহলে বয়স অভিজ্ঞতা- এই শব্দগুলোর ব্যবহার হত না। তোর থেকে বয়স আমাদের অনেক বেশি। অভিজ্ঞতাও বেশি। তোমার জীবন চলার পথ সবে শুরু হয়েছে। ভাল পাত্র দেখে আমরা বিয়ে দেব। সেখানে তুমি সুখে থাকবে। শান্তিতে থাকবে। সোনালি মুখ টিপে হাসে। হাসছিস যে বড়- সুরমাদেবীর গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে। সোনালি মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, হাসব না। বাবা বলল ভাল পাত্র। ভাল পাত্রর সংজ্ঞা কী? ডেপোমো কোর না। এখানে ডেপোমোর কী আছে। আমি সংজ্ঞা জানতে চাইছি। সুরমাদেবী আর দেবেনবাবু দুজনেই চুপ করে আছেন। শোনো বাবা, দেখতে ভাল আর ভেতরে পচা- বুঝবে কী করে। একই গাছের সব ফল এক রকমের হয় না। এটুকু যখন বুঝতে পেরেছি তখন অমিতের সঙ্গে মেলামেশা করে এটাও বুঝেছি- অমিত নিডি, সৎ, ভদ্র। একটা মানুষের পরিচয়ের প্রারম্ভিক গুণাবলির লক্ষণ ওর মধ্যে আছে। সুতরাং- সুতরাং তুমি অমিতকেই বিয়ে করতে চাও। এই তো? থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। শোনো, তোমার মাথায় এখন ছেলেমানুষি বুদ্ধি থেকে গেছে। আর একটু বয়স বাড়লে তখন বুঝতে পারবে। অমিত সম্পর্কে তোমার কমপ্লিমেন্ট ঠিকই আছে পাশাপাশি এটাও জেনে রাখ- জীবনে চলতে গেলে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার খেতে টাকার দরকার। এটাই মূল এবং প্রধান। অমিতের যেটা নেই। ওর মতো স্টুডেন্ট চাকরি পেয়ে যাবে। চাকরি না কাজ? কোনটা? চাকরি বলতে বড় ফার্ম হাউস, ন্যাশনাল, মাল্টিন্যাশনাল থেকে শুরু করে সরকারি পর্যন্ত। আর যদি মনে কর কাজ- তাহলে কাপড়ে দোকান, সাইকেলের দোকান- স্টপ ইট বাবা। অমিতকে অত ছোট করে দেখ না। সুরমাদেবী বললেন, তুই যে দেখছি অমিতকে গলার মালা করে রেখেছিস। রেখেছিস না মা, রেখে দিয়েছি। ওকেই তো মালা পড়াব। বেয়াদপি করিস না। তোমরা উলটো পালটা কথা বলছ দেখে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। শোন, অমিত একটা ভ্যাগাবন্ড। পরের জন্য ওসব করা ভাল কিন্তু সেই বলে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে- ওটা বোকামি। সে তো তোমরা বলবেই। বাবা, তুমি এর মধ্যে ভুলে গেলে। মায়ের গলস্টোন অপারেশনের সময় ও কী কম করেছে? কোনও আত্মীয় স্বজন ধারে কাছে থাকে না। আমি তোমাদের একমাত্র সন্তান। তাও মেয়ে সন্তান। বাইরে দৌড়ঝাঁপের জন্য একজন পুরুষ মানুষের প্রয়োজন। অমিত থাকাতে সেটা উপলব্ধি করতে পার নি। একা সমস্ত দিক সামলে দিয়েছে। এই বিষয়ে তোর সঙ্গে একমত । কিন্তু ঘর-সংসার করতে গেলে টাকার প্রয়োজন। সেটা আসবে কোথা থেকে। এর জন্য চাকরির দরকার। সোনালির বাবা মা মানবে না, আর সোনালিও ছাড়বে না। শেষে একদিন রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিল। ঘরে বিদ্রোহ জানাল সোনালি। আর অমিতকে চাকরির কথা বলতে লাগল। তখনও দেখেছে ইন্টারভিউ দিতে যাবার পথে রাস্তার অচেনা অজানা কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অমিত কালবিলম্ব দেরি না করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধপত্র কিনে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবেই ফিরেছে। বিকালে দেখা হতেই সোনালি বলল, ইন্টারভিউ কেমন হল? ইন্টারভিউ? ভাল। খুব ভাল হয়েছে। সোনালি অমিতের চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে অমিত মিথ্যে কথা বলছে। চাপ দিতেই গড়গড় করে সত্যি কথাটা বলে দিয়েছে। তুমি কী এসব করেই বেড়াবে? অমিত উত্তরটা হ্যাঁ বা না দিয়ে সারে নি। দেখ, ওরাও কারও না কারও বাবা মা। ওরাও কারও না কারও দাদু ঠাকুমা। আমার নিজের দাদু ঠাকুমা- না পিতৃকূল না মাতৃকূল- কেউ নেই। যারা পাচ্ছে তাদের মুখে ওই হাসিটুকু যদি ফুটে ওঠে ক্ষতি কী। মানুষের জীবনইবা কতটুকু। একটা চাকরি, একটা ঘর-সংসার, ছেলে-মেয়ে, ভোগ আয়েশ করে ঘুমানো বা বেড়ানো- জীবন তো শেষ। তুমি এর মধ্যে আর কী কিছু করতে পারবে সোনালি? আর এই একটা জীবনেইবা সব কিছু করা যায় সোনালি? সব হয় না। তাই তো? তবু সদিচ্ছে থাকলে নিজের জীবনের জন্য কিছু, বাকিটা অপরের জন্য দেওয়া যায় বইকি। আর এইটুকু দিতেই অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছি। এর মধ্যে কী কোনও আনন্দ নেই? বল? অমিতের কথা শুনতে শুনতে আবেগে সোনালির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ঘরের ভেতর কখন যেন আবছা অন্ধকার নেমে আসে। বাইরে গোধূলির শেষ চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ঠ নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে সোনালি অমিতকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। দুজনের শরীরে উত্তাপ নেমে আসে। ধীরে ধীরে গায়ের বসন নেমে যায়। দুই যৌবনোদ্ধত নর-নারী একে অপরকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে। শরীরের তাপ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যায়। এরপর আর বেশি দেরি করে নি সোনালি। এক শুভ দিনে অমিত তাকে বৈধতার স্বীকৃতি স্বরূপ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছাড়াই সিঁথি রাঙিয়ে দেয়। সাত তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিল সোনালি। এর ঠিক দু’বছর আগে একটা অঘটন ঘটে যাওয়াতে অমিত যেন কীরকম হয়ে গিয়েছিল। সেইবার শীতে দিনুদার সঙ্গে ক্লাবে একটু মনোমালিন্য দেখা দিয়েছিল। যে নিজের জন্য কোনওদিন তাকায় নি তাকেই সেই বছর পাড়া ছেড়ে বেড়াতে যেতে হল। সেটাই যে শেষ বেড়ানো হবে তা কে জানতো। তবে এসব অমিতের কাছ থেকেই শোনা। দিনু রাজনীতি করে না। তিল তিল করে পাড়ার ক্লাবটাকে দাঁড় করিয়েছিল। সেই ক্লাব নাকি ভেতরে ভেঙে যাচ্ছিল। দিনু একদিন এসে দেখল ক্লাবের ঘরে পার্টির মিটিং হচ্ছে। মিটিং শেষ হবার পর খোঁজখবর নিল। কে বলেছে এখানে বসতে? কার পারমিশন নেওয়া হয়েছে? পার্টির মিটিং এর জন্য পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা ক্যারাম খেলতে পারে নি। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। দিনু ক্লাব সেক্রেটারির পদ থেকে ইস্তফা দিল। কালীপুজোর সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঠিক মত হল না। ভেতরে ভেতরে অনেকের আক্ষেপ দেখা দিল। কেউ কেউ দিনুকে বলল, অমিতকে বলল। আবার কেউ বলল না। দিনু রাগ করে অমিতকে বলেছিল- ক্লাবটা এভাবে ভেঙে যাবে ভাবতে পারি নি। বহু কষ্টে এটাকে দাঁড় করিয়েছিলাম। ভাল লাগছে নারে। এখন কী করবে? দেখি কয়েকদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসি। কিছু টাকা দে তো। অমিত তিনশো টাকা দিল আর সোনালির কাছ থেকে এনে দিল আরও দুশো টাকা। দিনুদার কাছে আর কত টাকা ছিল অমিত জানে না। দিনুদা চলে গেল পুরী বেড়াতে। ওখানে গিয়েও দিনুদা পরের উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু হাজার চার সালের ছাব্বিশে ডিসেম্বর ভোর রাত্রে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস দেখা দিল। চারদিকের হই হট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল দিনুর। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। চারদিকে জলে জলময়। শুনতে পেল এক মহিলার কান্নার শব্দ। সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে- আমার ছেলে জলে চলে গেল, আমার ছেলেকে এনে দাও। এই কথা শুনে দিনু সেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু জলের স্রোতে নিজেকে ব্যালেন্স করতে পারছে না। হঠাৎ কিসে ধাক্কা খেল মাথাটা। দিনুর সাঁতার দেবার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে থাকে। জলের ঢেউয়ে আবার ধাক্কা খায় পাথরে। তারপর সব শেষ। অমিত আর ওঁর কয়েকজন বন্ধু গিয়ে দিনুদার নিথর দেহটাকে নিয়ে আসে। এরপরই অমিত কেমন যেন হয়ে যায়। সোনালি মনে সাহস দিতে থাকে। ধীরে ধীরে অমিত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সোনালি ভেবেছিল ও একটা চাকরি পেলেই বিয়েটা সেরে নেবে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি আসার আগেই সোনালি অমিতকে বিয়ে করে নিল। অমিত আবার প্রাণ ফিরে পেল। ঘর-সংসার, গোটা কতক ভাল টিউশনি- এভাবেই চলছে। তবে সেটাও খুব বেশিদিন স্থায়ী থাকল না। কারণ দিনুদা নেই। এখন অমিতের কাছে নানা লোকজন আসে ইনজেকশন দিতে, সেলাই কাটাতে বা সেলাই করাতে। ফলে সোনালিকে রান্না থামিয়ে গরম জলের ব্যবস্থা করে দিতে হয় সিরিঞ্জ ধোবার জন্য, নিডল পরিষ্কার করার জন্য। একদিন একটি অল্প বয়সি মেয়ে এসে হাজির। সঙ্গে ওঁর বাবা। মেয়েটিকে পাছাতে ইনজেকশন দিতে হবে। সোনালি ওসব জানে না। সে গরম জল করে দিল। অমিত সিরিঞ্জ ধুয়ে, নিডল ধুয়ে ওষুধ ভরে তৈরি হল। নে বিছানায় শুয়ে পড়। মেয়েটি শুয়ে পড়ল। কোনদিকে নিবি? ডানদিকে। অমিত ওঁর জামা তুলে প্যান্ট একটু নামিয়ে ইনজেকশন পুশ করে দিল। ঠিক সেই সময়ে সোনালি ঘরে ঢুকে দেখতে পেল ওই দৃশ্য। তখনই কিছু বলল না। মেয়েটি বিছানা থেকে নামতেই ওঁর বাবা বলল, আগামীকাল আর একটা দিয়ে দিতে হবে। ঠিক আছে। ওরা চলে যেতেই সোনালি বলল, তুমি কী গো। বাইরের একটা মেয়েকে আমাদের বিছানায় শুইয়ে দিলে? পরের দিকে চেয়ে নিজের আর কী কী ক্ষতি করবে বল তো। ক্ষতি! ক্ষতির কী হল। বাহ। মেয়েটার কী না কী রোগ তার ঠিক নেই, হেগো জামা-কাপড় কিনা কে জানে আর তুমি তাকে বিছানায় শুইয়ে ইনজেকশন দিলে। সেই বিছানায় আমরা শোব। এই বলে সোনালি বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকনা ওয়ার সব তুলে নিয়ে গেল। আবার আসবে বলেছে। কাল অন্য ব্যবস্থা করে নেবে। রোজ রোজ বিছানার চাদর কাচতে পারব না। অমিত বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দার পজিশন দেখল খুব ভাল করে। তারপর মনে মনে প্ল্যান করতে লাগল। কী করে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা যায়। অমিত কাউকে কিছু না বলে বের হল। বিশ্বাস ফার্নিচারে একটা সিঙ্গল বেড এর কত খরচ জানতে চাইল। একদম কমা কাঠের হিসেব করবেন। আম কাঠ দিয়ে করলেও হাজার টাকা লাগবে। এর কমে হবে না? না দাদা। অমিত রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকে- যারা বাড়ি বানাবার জন্য কাঠের পাটা, বাঁশের খুঁটি ভাড়া দেয় তাদের কাছ থেকে কম দামে কিনে যদি ছয় ফুটের লম্বা একটা বেঞ্চ বানানো যায় তাহলে কেমন হবে। এই ভাবনা মাথাতে আসতেই জহরদার কাছে গেল। জহরদা সব শুনে বলল, আইডিয়াটা খারাপ না। ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত লাগবে? আপনার কাছ থেকে আমি টাকা নেব। সেদিন আপনি না থাকলে আমার ছেলেটাই বাঁচতো না। আপনারা লোকের জন্য যা করেন, আপনাদের জন্য আমি কিছু না করে দিলে আল্লা তালাহর কাছে মুখ দেখাব কেমন করে। আপনি কাল সকালে বাড়ি থাকবেন তো? আপনি লোক পাঠালে থাকব। অবশ্যই পাঠাব। নতুন পাটা, নতুন বাঁশের খুঁটি নিয়ে আমার লোক ঠিক সময়ে গিয়ে একটা চৌকি করে দেবে। সকালে অমিতকে ঘরে থাকতে দেখে সোনালি বলল, আজ পড়াতে যাবে না? না। একজন আসবে। এই রকম কামাই করলে টিউশনি থাকবে? অমিত চুপ করে থাকে। মাসে ক’টাকা হাতে তুলে দাও? ওই টাকা দিয়ে ক’দিন চলে? সেরকম হলে বাবার কাছে চাইবে। অসম্ভব। কেন? অসম্ভব কেন। আমি তোমার কাছে চাইতে পারি বাট তোমার বাবার কাছে নয়। ঠিক আছে আমি চেয়ে দেব। তুমিইবা কেন চাইবে। তুমি একটা চাকরির ব্যবস্থা কর। সেটা না করে-। ঠিক সেই সময় একজন দরজার কাছে এসে বলল- বাড়িতে কেউ আছেন। কে? অমিত বাইরে এল। দেখল একটি অল্প বয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বলুন। আমাকে জহরদা পাঠালেন। ও আচ্ছা। আসুন। সোনালি বের হয়ে এসেছে। দেখল বাঁশের খুঁটি, কাঠের পাটা আর কীসব নিয়ে একটি ছেলে বাড়ির ভিতর ঢুকছে। কী হবে ওসব দিয়ে? অমিত বলল, দেখইনা, কী হয়। আর কত দেখব বল তো। এই বলে সোনালি ঘরের ভিতর চলে এল। হাতুরি পেরেকের খট খট শব্দ শুনে অমিতের বাবা মা একবার এসে দেখে গেলেন। কাবেরীদেবী, অভীকবাবুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, এটা কী হচ্ছে। অভীকবাবু কিছুটা আন্দাজ করে বললেন, মনে হচ্ছে তক্তাপোষ। অমিত বাবাকে দেখে বলল, বাবা কেমন হল বলতো। অভীকবাবু নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বললেন, ভাল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে গেলেন। # অমিতদা, ও অমিতদা- কে? ভিতর থেকে সাড়া দিলেন অভীকবাবু। বাইরে এসে দেখলেন দু’টি ছেলে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। কাকু, অমিতদা নেই? না, বাবা। ও ভেলোরে গেছে। কবে ফিরবে? আজকালের মধ্যে ফিরবে কি? মনে হয় না। ছেলে দুটো চলে যেতেই খালি তক্তাপোষ দেখতে পেলেন। নিজের ঘরে ঢুকতেই কাবেরীদেবী বললেন, কে এসেছিল? চিনি না। পাড়ার হতে পারে আবার বাইরেরও হতে পারে। ছেলেটা দশের কাজ করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাল না। কত বুঝিয়েছি। বুঝল আর কোথায়। বললাম, ইংরাজী নিয়ে এম এ পাশ করে বি এড কর। শুনলই না। কী একটা পরীক্ষা দিতে গিয়ে সেই ভোর রাত্রে বাড়ি ফিরল। মনে আছে? হ্যাঁ। এস এস সি-র পরীক্ষা। সত্যি, কী বলবে এটাকে। কথাতেই বলে নিজের বুঝ নাকি পাগলেও বোঝে। আমাদের ছেলে পাগলের থেকেও অধম। ব্যাঙ্ক থেকে এস এস সি-র ফর্ম কিনে আনল । ফিলাপ করে জমা দিল। পড়তে শুরু করল। অনন্ত সরখেলের কাছে গেল জেনারেল নলেজ শিখতে। বিয়ে করল। সংসারী হল। হয়তো দায়-দায়িত্বের কথা ভেবে এবার চাকরির জন্য পড়াতে মন বসাল। ভাবলাম সোনালি নানাভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওঁর মতি গতি ফিরিয়ে এনেছে। টানা ছয় মাস পড়াশোনা করে নিজেকে প্রস্তুত করল। আলটিমেটলি কী লাভ হল! কাবেরীদেবী বললেন, শুধু কী তাই। সেদিন আমাদের অবস্থা কী হয়েছিল। অপরকে সুস্থ করতে গিয়ে ওঁর চিন্তায় চিন্তায় আমরাও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। অমিতের সেদিন এস এস সি পরীক্ষা। ওঁর পরীক্ষা ছিল সেকেন্ড টার্মে। সকালে ঊঠে বাজার করল। টিফিন করল। চা খেল। তারপর একটা ফাইলে নিজের অ্যাডমিট কার্ড, পেন টুকিটাকি দু একটা জিনিস ভরল। বেলাতে স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল পরীক্ষা দিতে। রাজ কলেজে সিট পড়েছে। ভিড়ের জন্য খোসবাগান দিয়ে না গিয়ে বাদামতলার রাস্তা ধরল। সেখান থেকে পার্কাস রোড হয়ে বাদিকে বুড়িরবাগান হয়ে চলে যাবে। দু চার মিনিট সময় বেশি লাগলেও জ্যামে পড়তে হবে না। সেই রকম প্ল্যান করে অমিত এগিয়ে চলেছে। সবে বুড়িরবাগান রোড পার হয়ে তিনি রাস্তার মোড়ে এসে উঠবে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অল্প বয়সি ছেলে প্রচন্ড জোরে মোটর বাইক নিয়ে উলটো দিক থেকে আসছে। তিন রাস্তার মুখে জাস্ট একটু আগে ছেলেটার হ্যান্ডেল দেখে বোঝা গেল ছেলেটা বাঁদিকে যাবে। অমিত বুঝতে পেরে যায়। তিন রাস্তার মুখ বলে সে-ও একটু সাবধানতা অবলম্বন করল। ওঁর ঠিক ডান দিক দিয়ে একজন পঞ্চাশোর্দ্ধ লোক সাইকেলে করেই আসছে। তিনি বুড়িরবাগানের রোড ধরবেন। মোটরবাইকের পিছনে বসা ছেলেটা হঠাৎ বলে উঠল- এদিক দিয়ে চল। বলেই হাতটাকে ডানদিকে দেখিয়ে দিল। বাইক চালক স্পীড না কমিয়েই গলির মুখে ঢুকে পড়তেই সাইকেল আরোহীর সাইকেলের মাঝ বরাবর ধাক্কা মারল। লোকটা ছিটকে সামনের ইলেকট্রিক পোষ্টে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে লাগল। অমিত প্রত্যক্ষদর্শী। ছেলেটা অ্যাকসিডেন্ট করেই জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। অমিত দেখল লোকটার মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। পথ চলতি কিছু লোক ছুটে এল। ছুটে এল হাসপাতালে বা খোসবাগানে ডাক্তার দেখাতে আসা কিছু পাবলিক। আহত লোকটি তখনও কাতরাচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কে নিয়ে যাবে দাদা। সবাই মুখে বলে সাহায্য করতে কেউ আগিয়ে আসে না। অমিত মাঝখানে পড়ে যায়। কী করবে? তার কোনটা করণীয়? দু মিনিটের মধ্যে সে ডিসিশন নিয়ে নিল। সামনের দোকানে সাইকেল আর ফাইলটা রেখে একটা রিক্সা ডেকে নিল। আপনারা একটু ধরে দিন। হাসপাতাল নিয়ে যাব। অমিতের কথা শুনে ভীড় পাতলা হয়ে গেল। কেউ সরে যেতে যেতে বলল, হুঃ, লোকটার কিছু হয়ে গেলে তখন থানা পুলিশ নিয়ে টানাটানি হবে। কেউ বলল, কী দরকার মশাই, পরের ঝামেলা নিজের কাঁধে নেওয়ার। আর একজন বলল, হয়তো আর একটু বাদেই টেঁশে যাবে। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানো। এসব কথা শুনে অমিতের কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। প্লীজ, ওনাকে একটু ধরে রিক্সাতে তুলে দিন। দেরি হয়ে গেলে সত্যি সত্যিই মারা যাবেন। ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে একটা ভিখিরি টাইপের লোক এসে আহত ব্যক্তিটিকে রিক্সাতে কোনওরকমে তুলে দিতে দিতে বলল- একজন উপকার করছে, আপনারা তাকে একটু সহযোগীতা করতে পারছেন না। যতসব বাজে লোক। এমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতেই অমিতের একজন পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে দেখে হয়ে গেল। ডাক্তার মন্ডল- ডাক্তার মন্ডল রোগী দেখেই বললেন, সর্বনাশ। একটা ট্রলিতে আহত লোকটিকে শুইয়ে ডাক্তার মন্ডল, দুজন নার্স আর অমিত ছুটে চলল ওটির দিকে। বাইরে তখন অমিত বেঞ্চের উপর বসে আছে।। তার জামা প্যান্ট সব রক্তে ভিজে গেছে। জামা-প্যান্টে রক্ত আগেও লেগেছে। সেই নিয়ে তার চিন্তা নেই। এখন ওর দু চারজন পরিচিত লোক দরকার। পরে হয়তো ব্লাড ডোনার লাগতে পারে। ওষুধ লাগতে পারে। বাইরে এস টি ডি বুথে যাবে নাকি এখানেই বসবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই ডাক্তার মন্ডল এসে বললেন, অমিত, কেস খুব সিরিয়াস। মনে হচ্ছে ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছে। সিটি স্ক্যান করাতে হবে। এগুলো আমি দায়িত্ব নিয়ে হাসপাতালের স্টাফ দিয়ে করাচ্ছি। আপনি যদি ওষুধগুলো আনাবার ব্যবস্থা করেন। অবশ্যই। প্রেসক্রিপশনটা দিন। অমিত ওষুধের দোকানে এসে প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলল, কত লাগতে পারে? তা ধরুন হাজার তিনেক। সব দামি ওষুধ লিখেছেন ডাক্তারবাবু। আপনি ওষুধ রেডি করুন আমি টাকার ব্যবস্থা করছি। অমিত দোকান ছেড়ে পকেট হাতড়ে দেখল সে ফোন বুক আনতে ভুলে গিয়েছে। তেমন কোনও নম্বরও ওঁর জানা নেই। কাকে ফোন করবে। এই চিন্তা করতে করতে বড়নীলপুরের চন্দন মিত্রের কথা মনে পড়ল। উনি ওখানকার নাম করা একটা ক্লাবের সেক্রেটারি। ওনাকে বিশেষ প্রয়োজনে রক্ত দিয়েছিল অমিত এবং ওর পাড়ার কয়েকজন। তাকেই ফোন করল সে। কিন্তু তিনি এখন অফিসে। অমিত অফিসের ফোন নম্বর জেনে অফিসেই ফোন করল। দাদা, আমি অমিত বলছি। বল ভাই। অমিত সংক্ষেপে সব জানিয়ে বলল, দাদা, হাজার তিনেক টাকা না হলে ওষুধ কিনতে পারছি না। প্লীজ একটু হেল্প করুন। শোনো, তুমি দাস মেডিকেলে চলে এসো। আমি ওদের ফোন করে দিছি। ওষুধগুলো ওখান থেকে নিয়ে নাও। আমি দুটো ছেলেকে পাঠাচ্ছি। ওরা তোমার সঙ্গে থাকবে। আমি পরে যাচ্ছি। রাত্রি নটা বেজে গেল অমিত তখনও ঘরে ফেরে নি। অভীকবাবু, কাবেরীদেবী আর সোনালি সকলেই ভেবে অস্থির। ছেলেটা পরীক্ষা দিতে গিয়ে এখনও বাড়ি ফিরল না। আবার কাকে নিয়ে কোথাও গেল কিনা কে জানে। কিন্তু একটা ফোন তো করতে পারত। ঘরের সবাই যে ওঁর জন্য চিন্তা করছে সেটা একবারও ভেবে দেখছে না। কাবেরীদেবী বললেন। যা কিছু ঘটনা, দুর্ঘটনা কি ওঁর সামনেই ঘটে? আর সেসব দেখতে পেয়ে ছেলে একদম স্থির থাকতে পারে না। তাকে নিয়ে নয় হাসপাতালে যাবে, নইলে ডাক্তারখানায় যাবে, থানায় যাবে, তা না হলে বাড়ির ঠিকানা জেনে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এতই যদি পরের উপকার করে বেড়াবি তাহলে এতদূর পড়াশোনা করলি কেন? শেষ কথা শুনে অভীকবাবু বললেন, বাহ, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, কিছু জিনিস জানতে গেলে পড়াশোনা জানা খুব দরকার। রাখ তো তোমার যুক্তিতর্ক। ছেলেটা কোথায় গেল একটু খবর নাও তো দেখি। কোথায় খবর নেব? বাহ, কী সুন্দর কথা। যদি অমিতের কিছু হয়ে থাকে- মা! আর্তনাদ করে ওঠে সোনালি। কাবেরীদেবী সোনালির কন্ঠ পেয়ে চুপ করে গেলেন। তিনিও জানেন ছেলের ব্যথা। কথাটা আচমকাই বেরিয়ে গেছিল। তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কী ঘরের মধ্যেই চুপ করে বসে থাকবে নাকি ছেলেটার একটা খোজ-খবর নেবে। সেটাই ভাবছি। কী করব। কাকে বলব। তুমি ভেবেই যাও। তোমার ভাবতে ভাবতে একটা ঘন্টা কেটে গেল। সোনালি বলল, আমি একটা কথা বলল? বল? পাড়ার অনিলদাকে একবার বলে আসব ? কী বলবে? আমার মন বলছে অমিত হাসপাতালেই আছে। অনিলদা গিয়ে একবার খোঁজ নিক। কাবেরীদেবী বললেন, তাই যাও। ও একটা খোঁজ নিয়ে আসুক। অভীকবাবু বের হয়ে গেলেন অনিলদাকে খবর দিতে। তুমি আর কতক্ষণ বসে থাকবে। যাও এবার দুটো মুখে কিছু দিয়ে নাও। সোনালি শুনল কিন্তু গেল না। প্রায় মিনিট পনেরো বাদে ঘরে ফিরলেন অভীকবাবু। ওনাকে দেখেই কাবেরীদেবী বললেন, কী বলল অনিল? বলল, আপনি ঘরে যান আমি খোঁজ নিচ্ছি। তারপর বললেন, জান, অনিলের কাছে একটা মোবাইল দেখলাম। আমার সামনেই কাকে যেন ফোন করল। খুব সুন্দর জিনিস। ভাবছি অমিতকে একটা কিনে দেব। ঠিক বলেছেন বাবা। বছরখানেক হল বাজারে মোবাইল এসেছে। খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। ল্যান্ড ফোন বহনযোগ্য নয়। এটা সঙ্গে থাকলে যে কোনও সময়, যেখান থেকে খুশি ফোন করে খবরাখবর নেওয়া যায়। বিজ্ঞান মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এগিয়ে চলে। যুগ অনুযায়ী তার প্রয়োজন অনুভব করে। প্রত্যেকটা জিনিস আবিষ্কারের পিছনে মানুষেরই চাহিদা, প্রয়োজন -এখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা। অনিল রাত্রি প্রায় বারোটার সময় খবর দিল অমিত হাসপাতালেই আছে। কী ঘটনা ঘটেছে সেটাও সংক্ষেপে বলে চলে গেল। সোনালি নিশ্চিন্ত হল। প্রায় ভোর রাত্রে ঘরে ফিরল অমিত। অমিতের তৎপড়তা থেকে শুরু করে ডাক্তারবাবুদের আপ্রাণ চেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে গেল। আহত লোকটি রাত্রি সাড়ে তিনটের সময় এক্সপায়ার করল। পরদিন সব শুনলেন অভীকবাবু, কাবেরীদেবী। সব শুনে অভীকবাবু বললেন, সে সব না হয় বুঝলাম কিন্তু নিজের ভবিষ্যত কী একবারও দেখবে না। পারলাম না বাবা। নিজের চোখের সামনে ওরকম একটা অ্যাকসিডেন্ট দেখেও চোখের সামনে পরীক্ষার কথা দুলে উঠেছিল। মুহূর্তে লোকটার ছটফটানি দেখে ভাবলাম- পরীক্ষা আগামী বছরেও দেওয়া যাবে, আগে একেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। অমিত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বাবা, যদি একটু লক্ষ্য কর দেখতে পাবে ধীরে ধীরে মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এরা সাধারণ চাকরির থেকেও গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করছে বেশি করে। একবিংশ শতক ইলেকট্রনিক্স এর এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। লোকের কাছে নানা ধরনের জব চলে আসছে। বিভিন্ন সাবজেক্ট চলে আসছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা সাধারণ পরীক্ষা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এই সমস্ত কোর্সে ভর্তি হচ্ছে। বাইরে চলে যাচ্ছে পড়তে। ফলে মানুষের জীবনধারণ বদলে যাচ্ছে। আমরা এই মফস্বল শহরে বসে যা কল্পনা করতে পারছি না। সেটা আমাদের অলক্ষ্যে লন্ডন, আমেরিকা, চীন, জাপানে ঘটে যাচ্ছে। এর সঙ্গে তোর একটা চাকরির কী সম্পর্ক? আছে বাবা আছে। এভাবে ধীরে ধীরে আজকের ছেলে-মেয়েরা কেরিয়ার সর্বস্ব হয়ে উঠলে আগামী দশকে দেখবে মানুষের সাধারণ অসুখ বিসুখে কাউকে পাশে পাবে না। এই আমিই যদি ওই ধরণের একটা কোর্স করে মুম্বাই, চেন্নাই কিম্বা ব্যাঙালোর চলে যাই তখন তোমাদের সামান্য জ্বরজারি হলে ওষুধটুকুও এনে দেবার জন্য কাউকে পাবে না। বারান্দার সামনে এসে পরিচিত লোক দেখে তাকে যে একটু ওষুধ এনে দিতে বলবে- সেটাও পাবে না। সকলেই ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে চলে যাবে। অভীকবাবুর চোখমুখের চেহারা পালটে যেতে থাকে। তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন- কী বলছিস তুই। ঠিকই বলছি বাবা। ধীরে ধীরে মানুষের মনে কমপিটিশনের কনসেপ্ট চলে আসছে। চলে আসছে অ্যাচিভ করার প্রবনতা। যে পাড়াতে সন্ধ্যাবেলায় হারমোনিয়াম, তবলা, মাউথ অরগ্যান, গিটার- এই সবের রেওয়াজ ভেসে আসত , এখন দেখ সব শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। সামান্য আঁকাটাও এখন স্কুলের সাবজেক্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্মশিক্ষা, ব্যায়াম- এসব বিষয় আজ ব্যাকডেটেড। তুমি তোমার ছেলের দিকে তাকাচ্ছ, রামবাবু, শ্যামবাবু, যদুবাবু- ওনারাও যদি নিজের নিজের ছেলে-মেয়েদের অ্যাচিভ করার পথে নামিয়ে দেন, দেখবে আগামী দশ বছর বাদে মানুষের সামান্যতম উপকারের জন্য কোনও মানুষ পাশে থাকবে না। হয়তো কোনও সংগঠন তৈরি হয়ে যাবে। যারা অর্থের বিনিময়ে কাজ করে দেবে। বাবা, যাদের অর্থ নেই তাদের পাশে কে থাকবে বলতে পার? এসব কথা শুনতে শুনতে অভীকবাবুর চোখে মুখে একটা গভীর চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠল। বাবা, জীবন ধারণ এক জিনিস আর জীবনকে ভোগের বিলাসিতায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া আর এক ধরণের মানসিকতা। এখনকার ছেলে-মেয়েদের একটু লক্ষ্য কর, দেখবে তাদের জীবন ধারণ কেমন পালটে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে পুঁজিপতি, শিল্পপতিরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে দিন দিন নতুন প্যাকেজ তাদের সামনে তুলে ধরছে। সামান্য আলুভাজা প্যাকেটে ভরে চিপস তৈরি করে রঙিন বিজ্ঞাপন দিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সামনে তুলে ধরল। প্রতিদিন ওই চিপসের কত প্যাকেট বিক্রি হয় তোমার ধারণা নেই বাবা। এটাই পরিবর্তন। একবিংশ শতকের আলাদা জোয়ার। একে তুমি আমি থামাতে পারব না। সত্যিই তো! এসব কিন্তু আমরা ভেবে দেখি নি বা ভেবে দেখি না। বাবা, সময় অলক্ষ্যে চলে যায়। ঠিক সময়ে তাকে ধরতে না পারলে শুধুই আপশোশ। তাতে সময়ের কিছু এসে যায় না। ওই অ্যাচিভমেন্টের জন্য পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। বর্তমানে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। স্বামী-স্ত্রী একটা সন্তান। বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট। একটা সন্তানকে দশদিকপাল বানাবার প্রতিযোগীতা অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। এভাবেই কী একটা সমাজ চলবে? চলতে পারে? এখনকার শিশুরা এতবেশি একগুয়ে, জেদি, অ্যাগ্রেসিভ মনোভাবাপন্ন কেন? কেন তারা একটু কিছু পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে? বাবা, যত শুনবে ততবেশি অবাক হবে। এই তো কিছুদিন আগের ঘটনা। একই স্কুলের একই শ্রেণির দুই ছাত্র। প্রথম ছাত্রটি স্কুলের ফার্স্ট বয়। আর দ্বিতীয়জন প্রথমজনের ধারে কাছে আসতে পারে না। তাই সে মায়ের কাছে মার খায়। মা মারতে মারতে বলে, কেন তুমি ফার্স্ট হতে পার না। তুমি বিষয়টাকে একবার ভেবে দেখ বাবা, যে ছেলেটার মেধা নেই তাকে তুমি কীভাবে প্রথম করবে? অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তাকে মারলেই কী তার মেধা বৃদ্ধি পেয়ে যাবে? তাই কখনও হতে পারে, নাকি হয়? তারপর কী ঘটল জান? অভীকবাবু মাথা নাড়লেন। মানে না। দ্বিতীয় ছাত্রটি প্রথম ছাত্রটিকে স্কুল ছুটির পর ডেকে নিয়ে গেল। বন্ধুকে সে অবিশ্বাস করতে পারে না। সে গেল। গলির ভিতর নিয়ে গিয়ে দুটো বাড়ির মাঝের অংশের ফাঁকা জায়গায় তাকে গলা টিপে খুন করল। পাশের পানাপুকুরে ফেলে দিয়ে সোজা বাড়ি। কী বলছিস তুই? চমকে ওঠেন অভীকবাবু। তাহলে বোঝ সমাজটা কোন পথে এগিয়ে চলেছে। সে পড়াশোনাতে মন না দিয়ে কীভাবে খুন করবে সেই প্ল্যান কষেছে। কই এই বুদ্ধিটা তো সে পড়াশোনাতে কাজে লাগাল না। এবার ভেবে দেখ, ফার্স্ট বয়টি মারা গেল। এবার দ্বিতীয় ছেলেটি কি প্রথম হতে পারবে? অভীকবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এরকম বহু ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে আমাদের সমাজে। কবে যে অভিভাবকেরা এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবে কে জানে। # কাবেরীদেবী বললেন, ছেলেটা ঘরে নেই পাঁচদিন হয়ে গেল। অভীকবাবু সে কথা শুনতে পান নি। তিনি অমিতের নানা কথা চিন্তা করছিলেন। আজ বুঝতে পারলেন- সমাজে অমিতের মতো একজন করে ছেলে থাকা খুবই দরকার। খুব প্রয়োজন। মানুষের অর্থ থাকলেও বিপদে আপদে উদ্ধার করার জন্য অর্থের থেকে একটা প্রকৃত মানুষের দরকার খুব বেশি। নাহ, ছেলেটা ঠিকই করেছে। কাবেরীদেবী বললেন- কী ঠিক করেছে? অমিতের কথা ভাবছিলাম। সত্যি, ওকে আমাদের প্রশয় দেওয়াটা বিফলে যায় নি। আমিও এই কথাটা ভাবছিলাম। আজ কণা কাজ করতে এসে বলল, গতকাল রাত্রে নাকি মুকুলবাবুর স্ত্রীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পাশের বাড়ির রতনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। ছেলেটা বাইরে থাকে। এই মুহূর্তে আসতে পারবে না। ব্যাঙ্কে টাকা পাঠিয়েছে। এখন মুকুলবাবু একা একাই হাসপাতালে বসে আছেন। পেটে যে দুটো দেবেন- সেটাইবা কে এনে দেবে কে জানে। আজ রবিবার। সোনালির স্কুল ছুটি। মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে। কণা এসেছে কাজ করতে। সোনালি মেয়েকে তুলে বিছানা ঝেড়ে পরিষ্কার করতে করতে কণা এল ঝাঁট দিতে। সোনালি এষাকে নিয়ে বাথরুমে গেল। দাঁত মাজিয়ে, চোখ মুখ ধুইয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। সবার জন্য চা আর এষার জন্য দুধ গরম করবে। অভীকবাবু আর কাবেরীদেবী ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। আজ রবিবার বলে তেমন কোনও ব্যস্ততা নেই। একটু বাদে চা দিয়ে গেল সোনালি। কণাও কাজ সেরে চলে গেছে। সোনালি মেয়েকে দুধ খাইয়ে পড়ার বই খাতা দিয়ে দিল। তুমি পড়। আমি বাজারে যাচ্ছি। কাবেরীদেবীর কাছে এসে বলল, মা, আমি বাজারে যাচ্ছি। এষা থাকল। একটু দেখবেন। সোনালি পায়ে চটি গলিয়ে বাজারে চলে গেল। সোনালিকে বাপের বাড়িতে কোনওদিন অর্থ সঙ্কটে পড়তে হয় নি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নিজস্ব কাজ ছাড়া বাইরের কোনও কাজ কখনও করতে হয় নি। বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। আজ সোনালি বিয়ের পর কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। একা হাতে ঘর এবং বাইরের দিক তাকে সামলাতে হচ্ছে। এটা সোনালি কখনও ভাবতে পারে নি। অমিতদেরও তেমন কোনও অর্থ সঙ্কট নেই। অমিত টুকটাক দু’চারটে টিউশনি করে। ওতে আর কী এমন হয়। শ্বশুরমশাই এখনও চাকরি করছেন। সংসারটা তিনিই চালান। তবু সোনালি কোথায় যেন বেধে যেত। হাজার হোক, স্বামীর ঠিকমতো রোজগার না থাকলে বৌ হিসাবে সোনালি হীনমন্যতায় ভুগত। সে স্বামীর কাছে টাকা চাইলে অমিত বলত- বাবার কাছ থেকে নিয়ে নাও। কিন্তু সোনালি চাইতে পারে নি। প্রয়োজনে ওঁর বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনেছে। এটা অমিত বুঝতে পারে সোনালি যখন প্রেগন্যান্ট। একদিন অমিত জিজ্ঞাসা করল- সোনালি, তুমি কি তোমার বাবা বা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছ? সোনালি অস্বীকার করল না। সে বলল, হ্যাঁ। তুমি মাসের প্রথমে যেটুকু টাকা দাও তাতে ঠিকমতো বাজার করলে দশদিনের বেশিও যায় না। তুমি জান আমি এখন প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার দেখান। ইউ এস জি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের ব্লাড টেস্ট, ওষুধপত্র কেনা- তোমার ওই টাকাতে সেসব হয় না। তার উপর একটু ভাল ফল সবজি- আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। এসব খরচ আমার। ওরাও আমার বাবা মা। মেয়ের দুঃখ কষ্ট ওরা সইবে কেন? বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর ঘর করে। দুঃখ কষ্ট তাদের হতে পারে কিন্তু তোমাকেও তোমার স্বামীর মান সম্মান আগে দেখতে হবে। প্রয়োজনে তুমি রোজগার করতে পার কিন্তু সেই বলে- দু হাজার সাত সালে এষা জন্মাল। ওঁর যখন সাত মাস বয়স তখন হঠাৎ খবর পেল খাঁ পুকুর এলাকায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খুলছে। তারা প্রাইমারি সেকশনের জন্য টিচার নেবে। সোনালি হেড মিসট্রেসের সঙ্গে দেখা করে বায়োডাটা জমা দিল। এর কিছুদিন পর ইন্টারভিউ লেটার পেল সোনালি। পাশও করে গেল। সোনালি পুজোর পরই জয়েন করবে। সোনালির চাকরি করবে এই কথা শুনে কাবেরীদেবী বললেন, কী দরকার বৌমার চাকরি করার। অভীকবাবু বললেন, দরকার আছে বইকি। আর দু’বছর পরে আমি রিটায়ার করব। মাইনে হয়ে যাবে অর্ধেক। সংসারের খরচ বাড়বে দিন দিন। দ্রব্যমূল্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওঁর চাকরিটা ওদের স্বাবলম্বী করবে। সোনালি ঘুরে ঘুরে বাজার করল। মাছ নিল। মেয়েটার জন্য একটু ফল মিস্টি কিনল। বাড়ি ফিরেই সকালের জলখাবার বানাবে। তারপর রান্না। সে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল। ঘরে ঢুকতেই কারও গলার আওয়াজ পেল। উঁকি দিয়ে দেখল রঞ্জন সরকার বসে আছে। চোখাচোখি হতেই সোনালিকে জিজ্ঞাসা করল- ভাল আছেন? ওই চলে যাচ্ছে। দেঁতো হাসি হাসতে হাসতে রঞ্জন সরকার বলল, সে তো বটেই, সে তো বটেই। অমিতটা তো সেরকম কিছু করে না শুধু লোকের উপকার করে বেড়ায়। বলুন তো অভীকবাবু, এভাবে কী দিন কাটে? অমিতকে কতদিন বলেছি- কোর্ট চত্বরে একটা ঘুমটি দিয়ে পান বিড়ির দোকান দাও। এই কথা শুনে সোনালি কেটে কেটে বলল, আপনি নিশ্চয় জানেন অমিত ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। ওরকম হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েশন ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবনের নিশ্চয়তা দেয় একটা চাকরি। ওঁর চাকরি করতে ভাল লাগে না। ওসব ভুল কথা। এখন যা চাকরির পরিস্থিতি চাইলেও পাওয়া যাবে না। আর পেলেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে। অভীকবাবু বললেন, ওসব কথা বাদ দিন। সবার মানসিকতা এক নয়। সোনালি ঘরে ঢুকে গেলেও ওত পেতে থাকল। রঞ্জন আবার বলল, অমিত কোথায় গেছে বললেন। ভেলোর। সোনালি বাজারের ব্যাগ রেখে চুপি চুপি দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। এই রঞ্জন সরকার অমিতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিল আজ সুযোগ বুঝে সেটার ঠিক জবাব না দিলে সোনালির মাথা ঠান্ডা হবে না। জুতসই একটা জবাব তাকে দিতেই হবে। দেখা যাক লোকটা কোন ধান্ধায় এখানে এসেছে। অভীকবাবু বললেন, আপনি অমিতের খোঁজ করছেন কেন? হ্যাঁ। এবার সেটাই বলি। আমার মিসেসের গলস্টোন ধরা পড়েছে। অমিতের অনেক ভাল ভাল ডাক্তার চেনা জানা আছে। কাকে দেখাব বা কোথায় অপারেশন করালে একটু সুবিধা পাওয়া যাবে – এই সব বিষয় নিয়ে একটু কথা বলতাম। বোঝেনই তো এখন সামনের দরজার থেকে পিছনের দরজার গুরুত্ব অনেক বেশি। চেনা জানা থাকলে পেশেন্ট একটু এক্সট্রা ফেসিলিটি পাবে। তার উপর নার্সিং হোমের যা বিল- অমিত পাশে থাকলে সেখানেও একটু সুবিধা পাব। ওঁর মোবাইল নম্বরটা দিন, কথা বলব। সোনালি ঘরে ঢুকে বলল, বাহ রঞ্জনবাবু, নিজের সুবিধা কোথায় পাওয়া যাবে তার খোঁজ নিতেই অমিতের দরকার পড়ল। তাই না? ও এসব করে বলেই- করলেওবা। এই তো একটু আগে বললেন, চাকরি বাকরি না করে পরের উপকার করে বেড়ায়। তা মনে করুন না অমিত চাকরি করে। কলকাতায়। সকালে যায় রাত্রে ফেরে। আসলে কী জানেন রঞ্জনবাবু, কিছু লোক থাকে যারা শুধু কোথায় সুবিধা পাওয়া যাবে সেটা খুঁজে বেড়ায়। আজকে আপনি যার কাছে নিজের সাহায্যের জন্য এসেছেন, সে একদিন আপনার ছেলেকে পড়াত। একটা মাসে চারদিন না পাঁচদিন কামাই করেছিল বলে আপনি মাস মাইনে থেকে ওই টাকাটা কেটে রেখেছিলেন। আপনারা অমিতের জন্য পায়ের পাতাটুকু ভেজাবেন না অথচ সে আপনাদের জন্য হাঁটু পর্যন্ত ঢোবাবে- এটা আপনি ভাবলেন কী করে? দয়া করে আপনি ওঁর সাহায্যের প্রত্যাশি হবেন না। আহ বৌমা, আলতোভাবে বললেন কাবেরীদেবী। না মা, যে যেরকম তাকে একটু তার দোষ ত্রুটি না ধরিয়ে দিলে হয় না। তাই না রঞ্জনবাবু। রঞ্জন মুখ ঢাকার জায়গা না পেয়ে একটা দেঁতো হাসি হেসে বললেন, আমি আসছি। রঞ্জন চলে যেতেই অভীকবাবু বললেন, অমিত এইসব করে বলেই তো লোকে ওর খোঁজ করতে আসে বৌমা। আমি সবাইকে বলি না বাবা। লোকটা একটু ওইরকম ধরণের। তিনি নিজে কিছু করবেন না, আর লোকে করলেই তার দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। আর তাছাড়া আজকে এসে অমিত সম্পর্কে যে কথাগুলো বলল, এতে এর উত্তর না দিলে লোকটা আরও পেয়ে বসবে। কাবেরীদেবী সোনালির কথা সমর্থন করে বললেন, এদিক দিয়ে ভাবলে বৌমা খারাপ কিছু বলে নি। আচ্ছা, আবার যদি রঞ্জন পাড়ার লোককে ধরে ধরে এই কথাগুলো বলে বেড়ায়- ওসব বলে কোনও লাভ হবে না বাবা। গোটা পাড়ার লোক জানে রঞ্জন সরকার লোকটা কেমন। আর রঞ্জনবাবুর কথা শুনে অমিতের বিরুদ্ধে গেলে লোকসান তাদেরই। সুতরাং ওসব নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। হঠাৎ সোনালি তৎপর হয়ে ওঠে, আপনারা বসুন আমি জলখাবার দিয়ে যাচ্ছি। শুধু রঞ্জনবাবুই নয়, এই রকম আরও দু’চারজন আছে যারা অমিতের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। তবে তারা রঞ্জন সরকারের মতো মাস মাইনে থেকে টাকা কেটে রাখে নি। অমিত ঘরে বসে সময় কাটিয়েছে, পড়াতে যায় নি – এমন তো নয়। অমিত পড়াতে যেতে পারে নি- এটা ঠিক কথা। সেই সময়টা সে হয়তো অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ডাক্তারখানা, হাসপাতাল কিংবা কারও রক্তের জন্য কোথাও গিয়ে থাকবে। পরে সেই সমস্ত বাড়ির অভিভাবকেরা পড়ানো থেকে অমিতকে ছাড়িয়ে দেয়। সোনালি ভেবে দেখেছে- দিতেই পারে। হাজার হোক তাদেরও কষ্টের টাকা। কিন্তু তাদেরই ছেলে বা মেয়ে খেলতে গিয়ে হাত পা ভেঙেছে, তখন তারা কোনওদিকে না তাকিয়ে সাহায্যের জন্য অমিতের খোঁজ করে। এটাই সোনালি মেনে নিতে পারে না। তখনও তো অমিতকে কোনও না কোনও টিউশনি বন্ধ রেখে তাদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়। সেই ফ্যামিলিও যদি অমিতকে ছাড়িয়ে দেয়- তখন এরা কী অমিতকে কোনও পারিশ্রমিক দেবে। দেয় নি দেবে না আর অমিতও প্রত্যাশা করে না। সোনালি ডিশে রুটি তরকারি নিয়ে বাবা মাকে খেতে দিয়ে এল। ম্যাগি দিল এষাকে। এষা মাকে দেখে বলল, মা আমার অঙ্ক হয়ে গেছে। বেশ। আগে খেয়ে নাও। তারপর ইংরাজি স্পেলিংগুলো মুখস্ত করে নিও। মা,বাবা কবে আসবে? অনেকদিন হল বাবা আসছে না। সোনালি মেয়েকে একটু আদর করে হেসে বলল- এইবার চলে আসবে। # ঘুম ভেঙে গেল অমিতের। হাত ঘড়িতে সময় দেখল। সকাল সাড়ে ছটা। ট্রেনের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখল। নীল আকাশ। ধূ ধূ করছে মাঠ। দূরে দূরে গাছপালা দেখা যাচ্ছে। ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। পায়ে চটি গলিয়ে বাথরুম সেরে শিবুদার কেবিনে গিয়ে দেখল ওরা জেগে গেছে। গুড মর্নিং এভরিবডি। বৌদি, রাত্রে কোনও প্রবলেম হয় নি তো? না ভাই। বলতে বলতে শিবুদার বৌয়ের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব, এই বারো তেরো দিন তুমি যদি আমাদের সঙ্গে না থাকতে- আবার ওসব কথা। এবার কিন্তু সত্যিই আমি রাগ করব। বৌদি শুয়ে শুয়েই মুচকি হাসল। এই তো। এই রকম হাসি মুখই দেখতে চাই। শিবুদা, আমি আমার জায়গায় যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে ডাকবে। অবশ্যই। অমিত নিজের জায়গায় এসে বসল। ততক্ষণে অন্যান্য কয়েকজনের ঘুম থেকে উঠে, বাথরুম সেরে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। এরা অপরিচিত। তবে প্রত্যেকেই হাওড়ায় নামবে। এদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এই বার্থে কোনও মহিলা যাত্রী না থাকাতে অনেক সুবিধা হয়েছে। অমিতের যদিও সে সবের বালাই নেই। তার কাছে ছেলে মেয়ে সব সমান। দিনুদা বলত, রোগী অলওয়েজ রোগী। রোগীর কোনও লিঙ্গ হয় না। তুই যদি লিঙ্গ নির্ধারণ করতে যাস তখন অনেকে অনেককিছু বলবে। তোর মনে নানা ব্যাপার উঁকিঝুঁকি দেবে। তখনই তুই পিছিয়ে যাবি। কিন্তু কারও পাশে দাঁড়াতে হলে ওসব দেখলে চলবে কীভাবে। সেই মুহূর্তে, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাকে রেসকিউ করা, ট্রিটমেন্ট দেওয়াই হচ্ছে আমাদের প্রধান লক্ষ। দিনুদার কথা মাথায় রেখে সেদিন এক কথাতে শিবুদাকে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। বাজার করে ফেরার পথে শিবুদার সঙ্গে দেখা। কোন এক আত্মীয় যাবে বলে শেষ মুহূর্তে সে যেতে পারবে না। এটা জানার পরেই দিশাহীন হয়ে পড়েছিল শিবুদা। হাতের কাছে অমিতকে দেখতে পেয়েই ঘটনাটা খুলে বলল। অমিত শুনে বলল- চল, আমি সঙ্গে যাচ্ছি। শিবুদা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সত্যি বলছ! অমিত শিবুদার হাত ধরে বলল, এদকম সত্যি। তুমি বাড়ি যাও। আমি যাচ্ছি। ঘরে ফিরে সোনালিকে সংক্ষেপে বলে ব্যাগ গুছিয়ে অমিত চলে গেল শিবুদার বাড়ি। কই শিবুদা, তোমাদের সব গোছানো হয়ে গেছে। হ্যাঁ। একবার দেখানো যাবে। কী? ব্যাগগুলো। একবার দেখে নিতে পারলে ভাল হত। ওই তো ওখানে রাখা আছে। অমিত চটপট ব্যাগগুলো দেখে নিল। ডাক্তারের সমস্ত প্রেসক্রিপশ, নানা ধরণের পরীক্ষার রির্পোট একটা ফাইলে রাখল। বৌদির গারমেন্টস একটা ব্যাগে। শিবুদার গারমেন্টস আর একটা ব্যাগে। একটা ছোট্ট ব্যাগে ব্রাশ, পেস্ট, তেল, সাবান, দাড়ি কাটার জিনিসপত্র, শ্যাম্পুর পাতা, সার্ফ এর দু চারটে পাতা, কিছু পুরনো প্লাসটিক প্যাকেট। গামছা তোয়ালে। ব্যাগ চেক করে বলল, শিবুদা, টাকা, এ টিএম কার্ড- নিয়েছি। মোবাইল চেক করেছ? মোবাইলে ব্যালেন্স ভরা আছে? কালকেই ভরেছি। বাহ, খুব ভাল। এবার তোমরা রেডি হয়ে নাও। ট্রেন কটার সময়? এখান থেকে সকাল এগারোটা দশের ট্রেনে হাওড়া যাব। এগুলো সব দিনুদা শিখিয়ে দিয়েছিল। বুঝলি অমিত, যার বাড়িতে বিপদ হয় সেই মুহূর্তে তাদের কারও মাথা ঠিক থাকে না। তখন আমাদের কী করা উচিত বলতো? অমিত জানে না। তাই সে মাথা নাড়াল। আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখা। খুব ইমপটেন্ট এটা। কারণ কী জানিস, তখন আশেপাশের কিছু লোক, মহিলা পুরুষ উভয়েই জ্ঞান বিতরণ করতে থাকে। এই করেই বাঙালি গেল। আর কিছু পারুক বা না পারুক শুধু জ্ঞান দিয়ে যাবে। যেই তাকে করতে বলবি- দেখবি কেমন দাঁত ভেটকাচ্ছে। সেই সময় মাথা ঠান্ডা রেখে সব দিকে নজর দিতে হয়। এটা আবার সবার ক্ষেত্রে এক নিয়ম নয়। রাস্তা থেকে উদ্ধার করলি, কেউ বাড়িতে চলে এসেছে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবি, রোগীকে এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে যাবি, ডাক্তার দেখানো হবে, ভর্তি হলেও হতে পারে- তখন একরকম। আমার পাশে থাক। দেখবি দেখতে দেখতে হাতে কলমে কাজ করতে করতে তোরও অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। কিছু জিনিস থাকে, শেখান যায় না, অভিজ্ঞতাতে কাজ হয় বেশি। সেই কবে থেকে দিনুদার সঙ্গে লেপটে গিয়েছিল অমিত। তখন পাড়ার বিভিন্ন কর্মকান্ডের মূল হোতা ছিল দিনুদা। বর্ষাকালে ড্রেন পরিষ্কার করা, এবড়োখেবড়ো রাস্তায় রাবিশ বা মাটি ফেলা, পাড়ায় চাঁদা তুলে গ্যামাক্সিন ছেটানো, ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট ম্যাচ, ক্যারাম প্রতিযোগীতা, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোতে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করানো সবেতেই দিনুদার অবদান থেকে গিয়েছে। বুঝলি অমিত, লেখাপড়া শুধু ডিগ্রি অর্জন করার জন্যই নয় তাকে সময় মতো কাজে লাগানোই প্রকৃত শিক্ষা। মানুষের মধ্যে সামাজিক চিন্তা ভাবনার প্রসার ঘটানোই আমাদের মূল লক্ষ। অমিত দিনুদার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কিন্তু মানুষের সেবা, পাশে থাকা সেটা তখনও অমিত পায় নি। প্রথম পেল রাজকুমারের বাবার ঘটনায়। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিল অমিত। দিনুদা অমিতকে দেখেই বলল, অমিত পায়ের তলা ঘষতে থাক আমি বুকে পাম্প করছি। এরমধ্যে আরও দু’একজন ছুটে এসেছে। তারাও হাত পা ঘষতে থাকে। কে একজন গিয়ে পাড়ার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার অজয়কে ডেকে নিয়ে এল। অজয় নাড়ি টিপে পরীক্ষা করে কিছু না বলে চলে গেল। রাজকুমারদের বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। কেউ কেউ ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। তখন দিনুদা বলল, হাসপাতাল নিয়ে চল। অরূপদের ভ্যানরিক্সায় চাপিয়ে রাতের অন্ধকারে জনাদশেক ছেলে নিয়ে হাসপাতাল রওনা দিল। রাজকুমারের বাবা এখানে থাকে না। কাজের জন্য বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। আজ সকালেই তিনি বাড়িতে এসেছেন। সন্ধ্যায় চপ মুড়ি খেয়েছেন। রাত্রিবেলা ভাত না খেয়ে লুচি আলুরদম খাওয়ার আধঘন্টা বাদে হঠাৎ শরীর ঘেমে ওঠে। বুকে ব্যথা শুরু হয়। রাজকুমার দিনুদাকে ডেকে আনে। অমিতরা হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে আসতেই দিনুদা একজন ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনল । তিনি রাজকুমারের বাবার নাড়ি ধরে পরীক্ষা করে বললেন, এক্সপায়ার করে গেছে। ভর্তি করলেই পোস্ট মর্টেম করতে হবে। পুলিশ ডায়রি হবে। অনেক ঝামেলা। লোকাল ডাক্তারের কাছ থেকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে নিন। অজয়ডাক্তার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমিত বুঝতে পেরেছিল কাকু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। অমিত চোখের সামনেই দেখতে পেল রাজকুমারের বাবার মৃত্যু। মৃতদেহ পাড়াতে এল। সারারাত জেগে থাকল কিছু ছেলে। ওদের আত্মীয়দের খবর দেওয়া হল। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল ভোর থেকে। পাড়া থেকে শ্মশান। শ্মশানে দাহ কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা তিনটে। এভাবেই অমিত ক্রমশ দিনুদার পাশে থেকে থেকে একসময় তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠল। অমিত উচ্চমাধ্যমিক পাস করল। কলেজে ভর্তি হল ইংরাজি অর্নাস নিয়ে। তার আগে সোনালির সঙ্গে মেলামেশা শুরু হল। আলাদা জীবন। আলাদা অনুভূতি। আলাদা একটা মজা। যেখানেই দিনুদা যাবে সেখানেই অমিত। এসব দেখতে দেখতে অমিতের নেশা লেগে গেল। আর চেপে রাখতে না পেরে একদিন দিনুদাকে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব? বল। তুমি আমাকে প্রেসার মাপা, ইনজেকশন দেওয়া, সেলাই কাটা- এই সব শিখিয়ে দাও। তুমি কোথাও গেলে তখন যদি কারও দরকার পড়ে তখন কী হবে। তুমি না ফেরা পর্যন্ত সে বসে থাকবে? দিনু এক গাল হেসে অমিতকে বুকে জড়িয়ে বলল, এই তো। এটাই তোর কাছ থেকে আশা করছিলাম। কিছুদিন আগে ভেবেছিলাম তোকে বলব। বল নি কেন? কাজটা বা বলা যেতে পারে সমাজসেবা যে করবে তার ভিতর থেকে ইচ্ছে না জাগলে সেটা ঠিক মতো কাজে আসবে না। এই জন্য বলি নি। যে কোনও কাজ করতে গেলে বা সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে সবার আগে দরকার মনের ভিতরের তাগিদ অনুভব করা। তারপর সেটাকে নিয়ে সাধনা করা- তবেই মানুষ উন্নতি করে। যা করব, যেটুকু করব সেটা যেন নিছক অবস্থায় না থাকে। করতে হয় করছি- এই মনোভাব যেন না থাকে। যদি সেরকম হয় তখন তার গুরুত্বটাও কমে যায়। অমিতকে রেডক্রশ ট্রেনিং-এ ভরতি করিয়ে দিল দিনু। সেখান থেকে সব কিছু শিখল। সাঁতার শেখাল। আপতকালীন অবস্থায় কী কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়- সেসব শেখাল। এভাবেই দিনুদার সঙ্গে পাড়া থেকে বাইরের দিকে পা বাড়াল অমিত। সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে থাকতে থাকতে বেশ কিছু ভাল ক্লাবের সঙ্গে পরিচিত হল। কিছু ভাল এবং পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য ভাল উকিলদের সঙ্গে পরিচয় হল। দিনুদা দু’পক্ষের ঘটনা শুনে বোঝবার চেস্টা করত কার দোষ। যারা দোষী তারা শাস্তি পাক- এটাই ছিল দিনুদার নীতি। সেই কাজেও দিনুদা সাফল্য পেয়েছে। কোনও ছেলে মেয়ে নিজেদের ইচ্ছায় ভালবেসে বিয়ে করার পর ছেলেটির বাবা মা মেয়েটিকে বৌমা হিসেবে মেনে নিচ্ছে না। তখন তারা মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য, কিংবা সোনাদানা আনার জন্য। এতে সংসারে অশান্তি। মেয়েটির উপর অত্যাচার। কিন্তু মেয়েটির বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। মেয়েটি দিনুদার দ্বারস্থ হলে দিনুদা পুলিশ দেখিয়ে, উকিল দেখিয়ে সাবধান করে দিয়ে এসেছে। আবার এমনও হয়েছে, দুঃস্থ লোকের চিকিৎসা করানোর জন্য ক্লাবে গিয়ে চাঁদা তুলেছে। গরিব বাবা মায়ের বিবাহ উপযুক্ত কন্যাকে চাঁদা তুলে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রক্তের জন্য পাড়ায় পাড়ায় ইয়ং ছেলেদের কাছে গিয়েছে। বিনা খরচে তাদের রক্তের গ্রুপ টেস্ট করিয়ে খাতাতে নোট করে রেখেছে। কত রাত-বিরেতে অমিতকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে গিয়েছে হাসপাতালে। কেউ মারা গেলে চাঁদা তুলে এনে সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। তবে অমিত দেখেছে- দিনুদা যার কাছে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে সে-ই তাকে সাহায্য করেছে। একদিন জিজ্ঞাসা করাতে দিনুদা হাসতে হাসতে বলল, এই সব লোকগুলোকে তুইও চিনে রাখ। আমি প্রত্যেকের কাছে তোর কথা বলে রেখেছি। কেন? বুঝতে পারছিস না? না। শোন, কথাগুলো গোপন রাখবি। কোথাও কোনওদিনের জন্য ফাঁস করিস না- এই বলে দিনুদা আরও কাছে টেনে নিয়ে অমিতকে বলল, ওনারা প্রত্যেকে বড় বড় অফিসের অফিসার র্যা ঙ্কের লোক। এরা প্রচুর পরিমানে ঘুষ পায়। সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখতে পারে না। সারা বছরের মধ্যে বেড়াতে যায়, কিছু সোনাদানা বা বাড়িঘরের জিনিসপত্র কেনে। যদি কেউ বছরে দু’তিন লাখ টাকা ঘুষ পায়- বাকি টাকা কিসে ব্যয় করবে। সেইজন্য ওরা এইসব কাজের জন্য পাঁচ দশ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করে, তবে কোনওভাবেই নামে দিতে চায় না। তুমি যে এত টাকা খরচ করে মানুষের জন্য কর, সেই টাকা কে দেয়? এনারাই দেয়। আমি ব্যাঙ্কে রাখি। আর ওই টাকা দিয়েই পরিষেবা দিই। তবে এরমধ্যে একটা কথা আছে, আমি ওই টাকা নিজের জন্য ব্যয় করি না। আমার আর সংসার বলতে কীইবা আছে। বৃদ্ধ মা ছিল, গত দু’বছর আগে সে-ও চলে গেল। মা মারা যাওয়ার আগে দাদাকে একদিন বলেছিল- দিনু যদি কিছু নাও করে তবু ওকে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দিস বাড়ির পাহাড়াদার মনে করে। বুঝলি অমিত, আমি যে পরের নানা কাজে নানা ঝামেলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখি এরজন্য মা কোনওদিন দুঃখ প্রকাশ করে নি। উপরন্তু আনন্দ পেয়েছে। একদিন আমার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, মানুষের সেবা করাই পরম ব্রত। তাদের আশীর্বাদ তোকে আগামী জন্মে বড় মনীষী করে তুলবে। যদিও আমি এইসব মানি না। মা মানে। যে মানে তাকে বারণ করা ঠিক নয়। কী বলিস? একদম ঠিক। একদিন মাকে বলেছিলাম, মা, তুমি নিশ্চয় আগামী জন্মে আমার মতো বাউন্ডুলে ভবঘুরে পরোপকারী ছেলে চাইবে না। তাই না। জানিস এক কথা শুনে মা কেঁদে ফেলেছিল। চোখ মুছে বলেছিল- আমি তোর মতো ছেলেই চাইব বাবা। জনম জনম তোর মতোই ছেলে চাইব। আচ্ছা দিনুদা তোমরা তো ব্রাহ্মণ। তুমি পুজো, বিয়ে, শ্রাদ্ধ এইসব কাজ করতে পার। উহু। বল বামুন। যারা ব্রহ্মার উপাসক তারাই ব্রাহ্মণ। আর পুজো করলেই কী ঈশ্বরকে পাব? তাই কখনও হয়? বিবেকানন্দ বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। মানুষই ঈশ্বর। কথায় বলে না, ও শিশু, ওঁর গায়ে পা দিতে নেই- তাহলে শিশুকালে ঠাকুর থাকে তারপর আর থাকে না? থাকবে না কেন? মানুষ নিজেই সেগুলো নষ্ট করে, বিনাশ করে। মানুষের যখন নিজস্ব বোধ বুদ্ধি তৈরি হতে থাকে তখন থেকেই সে তাঁর মূল পবিত্রতা বিসর্জন দিতে থাকে। যেমন- সে হবে মিথ্যাবাদী, লোভী, কামুক- এই সমস্ত কুৎসিত রিপুগুলোকে যতক্ষণ না সে পরিত্যাগ করতে পারবে- সে ঠাকুর থাকবে না। ঈশ্বরকে যদি মানুষের সঙ্গে তুলনা করি তখনই মানুষ প্রথমে স্থান নেয়। তোমার গুরুদেব কে? আমার গুরু মা, বাবা। আর যার পথ ধরে আমার এগিয়ে চলে তিনি হলেন বিবেকানন্দ। ওনার আদর্শকে মাথায় নিয়েই আমি এগিয়ে যাই। এসব অনেক জটিল ব্যাপার। ঠিক বুঝবি না। বল। আমি শুনব। বিবেকানন্দ বলেছিলেন- পরোপকারই ধর্ম। সমস্ত মানুষকে পুজো কর। এই পুজো করাটাই প্রধান। তুই দুর্গাপুজো করলি, তার কাছে কিছু চাইলি, সে দিল না- তাকে কি তুই মারবি? মারবি নাতো? তাহলে সমাজে থেকে কেন আমরা বিবাদ করি, লাঠালাঠি করি, হিংসা করি, নিজের ভোগ ঐশ্বর্যকে বৃদ্ধি করতে অসৎ পথ অবলম্বন করি। আমি যদি তাদের সকলকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করি তাহলে তার সঙ্গে বিবাদ করব না। এই মনোভাব সকলের থাকলে সমাজের চেহারাটাই বদলে যেত। কিন্তু তাই কী হচ্ছে? মানুষ খুব উন্নত জীব। কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই বলেই যত মত তত পথ। তবে সবশেষে বিলীন। আমিও হব, তুইও হবি। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য মনুষ্যধর্মটাকে কেন বিনষ্ট করব। আমার কাছে গরিব-বড়লোক, হিন্দু-মুসলমান, ডোম-মেথর, ডাক্তার-কবিরাজ— সকলেই সমান। দেহের যে কোনও অংশ কাটুক না কেন ব্যথা লাগবেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রের দশজনকে পরপর দাঁড় করিয়ে চাবুক মারলে ব্যথার অভিব্যক্তি কিন্তু একই হবে। আমি এটাকেই ভিতরে ভিতরে রিয়েলাইজ করি। বিবেকানন্দকে জানার চেষ্টা কর, তার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো মেলাতে চেষ্টা কর- অনেক কিছু জানতে পারবি বুঝতে পারবি। আজ দিনুদা নেই। সুনামির সময় সে পুরীতে ছিল। তখনই কাকে উদ্ধার করার জন্য সেই প্রবল জলরাশিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। মাথায় বোল্ডারের আঘাতে অকালে চলে গেল দিনুদা। আজ বহু বছর পর ওঁর নানা কথা, নানা স্মৃতি চলন্ত ট্রেনের কামরায় ভেসে ভেসে আসছে। দিনুদা এতসবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখলেও কখনও রাজনীতি করে নি। সে কথাও একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল অমিত। জানিস অমিত, রাজনীতিটা আমার ধাতে সয় না। সেই বলে রাজনীতিকে ঘৃণা করছি না। রাজনীতি একটা বড় সংগঠন। বৃহত্তর কর্মকান্ড। যা একার পক্ষে করা যায় না। রাজনীতি কী সামাজিক কাজ করে না? অবশ্যই করে। তবে তার গতি প্রকৃতি অন্যরকম। ধীরে ধীরে সেই রাজনীতিতেই ক্ষমতার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। কত নতুন নতুন দল তৈরি হচ্ছে। সেই দিকে মানুষ চলে যাচ্ছে। আসলে পার্টি হয়ে গেছে সুবিধাবাদীদের। যারা পুরনো দলে সুবিধা পায় নি তারাই এই সুযোগে নতুন দলে ঢুকে যাচ্ছে। তাতে কী সত্যিই মানুষের উপকার হবে? হলে কতটা? সেটাই ভেবে দেখবার। আমারও পার্টি পলিটিক্স ভাল লাগে না। তোকে আগেই বললাম, ওটা বড় সংগঠন। আমরা কোনও সংগঠন নই। ভাল লাগে বলে মানুষের বিপদে আপদে থাকি, তাদের সেবা করি- এটাই আমাদের পথ। যে কোনও কাজের সফলতার মূল ভিত্তি সাধুতা। ওই সাধুতার উপর নির্ভর করে যে কোনও পরিকল্পনা রূপায়ণ করা সম্ভব। কিন্তু রাজনীতির মধ্যে দেখেছি- পরিকল্পনা রূপায়ণে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তারা শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, চরিত্রবান নয়, নিঃস্বার্থপর নয়। যারা আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগীতা করে তারাও তো ওই দলেই পড়ে যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছেন কয়েকজন। ঠিক বলেছ তুমি। সামান্য কলেজ রাজনীতিটাই দেখ। যারা কলেজে পড়তে আসে সবাই আটারো বছরের উর্ধে। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে, ব্যক্তিগত যে কোনও রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য হতে পারে। সেটাই যখন কলেজে চলে আসে বিষয়টার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। কলেজে একটাই দল হওয়া উচিত। তাদের আন্দোলন হওয়া উচিত কলেজ ইস্যুকে কেন্দ্র করে, কলেজের শিক্ষাদীক্ষার মান নিয়ে, কলেজ ল্যাবরেটরির জিনিস কেনা হচ্ছে না কেন? কেন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না-এইসব নিয়ে তাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে কী সেটা হচ্ছে। সেখানে মূল রাজনৈতিক দলের প্রচার চলছে। কলেজ ইস্যু মূল রাজনৈতিক দলের ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। এর কী কোনও পরিবর্তন হয় না? দিনু অমিতের কথা শুনে হা হয়ে গেল। তুই কী কথাটা ভেবে বললি, নাকি না ভেবে? অমিত দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কী বলবে বা কোনটা বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। না, মানে- থাক। আমাকে আর বোঝাতে আসিস না। তুই না ভেবেই কথাটা বললি। পরিবর্তন কী অত সহজেই করা যায়? দেশের পরিবর্তন আনতে গেলে প্রথমে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। আমার সঙ্গে তুই কতবার হাসপাতালে গেছিস, বিভিন্ন নার্সিং হোমে গেছিস- কোথাও কী দেখেছিস সততা দিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে। হাসপাতালে রোগী ভরতি করিয়ে দিয়েই আমরা চেনা জানা ডাক্তার, নার্স এমনকি ট্রলিবয়দের পর্যন্ত খোঁজ করি। কেন? কীসের জন্য? চেনা থাকলে যত্ন পাবে, সঠিক ট্রিটমেন্ট পাবে, মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের দিয়ে যাওয়া স্যাম্পেল দেবে, ডাক্তারবাবুরা নট ফল সেল লেখা ওষুধ দেবে। কেন এটা সবার জন্য নয়। নার্স বা ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে কেন বলাবে বাইরে দেখাতে। তুই তো সেদিনের বাচ্চা ছেলে, আচ্ছা আচ্ছা নেতা-মন্ত্রীরা এর উত্তর দিতে পারবে না। ‘বৈষম্য’- এটা একটা সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। একে পরিবর্তন করা অতটা সহজ ব্যাপার নয়। ট্রেন কোন একটা স্টেশনে থামল। অমিত যেখানে বসে আছে স্টেশনের নাম দেখা যাচ্ছে না। অমিত জল খেল। বাইরের দিকে চোখ রাখল। বেশ ঝকঝকে আকাশ। দিনুদা মারা গিয়েছে দু’হাজার চার সালের ডিসেম্বরে। এটা দু’হাজার তেরো। মানে আজ থেকে নয় বছর আগে দিনুদা চলে গিয়েছে। ন’বছরেরও আগে বলা কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। দু’হাজার ছয় সালেই দেখেছিল পাড়ার রাজনৈতিক অবস্থান। পাড়াতে এতদিন একটা পার্টিই প্রচার করত। মিটিং মিছিল করত। সেই বছরই ভোটের আগে দেখল দুটো দল মিটিং মিছিল করছে। শাসকদল এসব মেনে নেবে না আর নতুন দল নতুন উদ্যমে উদ্যোগে প্রচারে আসতে চাইছে। ফলে পাড়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেল। দেখে নেবার হুমকি। দেখিয়ে দেবার হুমকি। অমিত কোনওদিকে না থাকলেও দুটো দলই ওকে পাত্তা দিতে থাকে। অনেক অজানা গোপন তথ্য চলে আসে ওঁর কানে তবু সেসবকে উপেক্ষা করে অমিত নিজের কাজ করে যেতে থাকল। দিনুদার গড়ে যাওয়া ক্লাব মুখ থুবড়ে পড়ল। এটাই ওকে বেশি করে কষ্ট দিয়েছিল। এক রবিবার শাসক দল ক্লাবঘরে বসে মিটিং করল, পরের রবিবার ক্লাবঘরে বসে মিটিং করল অন্য এক দল। এই নিয়ে বচসা। মারামারি। শাসকদল ক্লাবের গেটে নিজেদের দলীয় পতাকা টাঙিয়ে দিল। এবার যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে সেটা স্থানীয় রাজনৈতিক ইস্যু করে প্রচার করা হবে। অমিতের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। তবু সে এটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সে ক্লাব সম্পাদক সুদীপকে বিষয়টা বলতেই উত্তেজিত হয়ে বলল- অমিত, তুই কী তলায় তলায় ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিস? হঠাৎ এই কথা কেন? তাহলে আমাকেই বা এটা বলছিস কেন? বলছি আমরা একই পাড়ার ছেলে। একই ক্লাবের মেম্বার, একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি- তো- আমি ক্লাবের মেম্বার। আমার কোনও বিষয় জানার অধিকার নেই? অধিকার! অবাক হয়ে গেল সুদীপ। অধিকার? অধিকার আবার কী জিনিস? যা করেছি পাড়ার ভালর জন্য। পার্টির জন্য। তুই যদি অন্য দলে নাম লিখিয়ে থাকিস- সেটাও কিন্তু তোর পক্ষে ভাল হবে না। অমিত কোনও কথা না বাড়িয়ে ফিরে আসে। সেই প্রথম দেখল পার্টি কী রকম ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ক্লাব ভেঙে গেল। অমিতের বয়সি বন্ধু-বান্ধবরা নতুন দলে নাম লেখাল। ক্লাবের পুজো বন্ধ হল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে গেল। সাংস্কৃতিক পরিবেশ, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে যে সুষ্ঠু সমাজ- সেসবে পাতলা ফাটল দেখা দিল। খুব কাছ থেকে না দেখলে সেটা বোঝা যাবে না। তবে অমিত থেমে থাকে নি। গোটা পাড়ার খোঁজ খবর নিত। কারও বিপদে আপদে একাই গিয়ে দাঁড়াত। সোনালি ইনজেকশন নিতে ভয় পেত। সেই সোনালিও একদিন রক্ত দেবার জন্য অমিতের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। তখন রাত্রি প্রায় একটা। কয়েকটা ছেলে অমিতকে ডাকতে এল। কী ব্যাপার? দাদা, আমাদের এক বোতল রক্ত লাগবে। এমার্জেন্সি। অমিত ছেলেগুলোকে একটু ভাল করে দেখল। দু’একজন পরিচিত মুখ। তাদেরই একজন বলল, ওরা আমার কাছে গিয়েছিল। আমার ব্লাড গ্রুপ মিলছে না। তাই ওদেরকে আপনার কাছে নিয়ে এলাম। কোন গ্রুপের রক্ত? এ পজেটিভ। ব্লাড গ্রুপের নাম শুনেই অমিতের ঘুম ঘুম চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। সে তাড়াতাড়ি করে সোনালিকে ডেকে তৈরি হতে বলল। সোনালি ঘড়ি দেখল। রাত্রি প্রায় একটা দশ। কোথায় যাব এত রাত্রে। চল। যেতে যেতে বলছি। এই বলে অমিত বাথরুম থেকে ঘুরে এসে তৈরি হয়ে নিল। কী হল? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। কীসের জন্য সেটা বলবে তো- এক বোতল রক্ত দিতে হবে। ওরে বাবা। ও আমি পারব না। প্লীজ সোনালি। দেরি হয়ে গেলে পেশেন্ট এক্সপায়ার করে যেতে পারে। সোনালি নিমরাজি হয়েও অমিতের সঙ্গে গেল এবং এক বোতল রক্ত দিয়ে ফিরল। পরদিন সোনলিকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। কী ব্যাপার। মুখ চোখের মধ্যে অন্যরকম একটা ছাপ দেখতে পাচ্ছি। কই, কিছু না। আমার চোখকে ফাঁকি। সোনালি হেসে ফেলল। জানো, প্রথম প্রথম ভয় লাগলেও এখন ভয় কমে গেছে। কথা শুনে অমিত সবার অলক্ষ্যে সোনালিকে একটা চুমু দিয়ে বলল, এই না হলে আমার সহধর্মিনী। আচ্ছা, আমার রক্তের গ্রুপ না মিলে যদি তোমার বাবার বা মায়ের রক্তের গ্রুপ মিলে যেত তাহলে কী তুমি তাদের নিয়ে যেতে। অবশ্যই। হয়তো একটু কষ্ট পেতেন। কিন্তু তাদের দেওয়া এক বোতল রক্তে একটা মানুষের জীবন বেঁচে যেত। সেটা কী কম আনন্দের। জানো সোনালি, দিনুদা বলত- দানেই বেশি আনন্দ। রক্তদান, শ্রমদান, অর্থদান- এর বিনিময়ে তারা সমাজের কত বড় উপকার করেন এটা বুঝতে পারলে আর পিছিয়ে থাকতে পারবেন না। সোনালি চা দেয় অমিতকে। অমিত চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমাদের সমাজ শিক্ষাটা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক চিন্তা-ভাবনা কেউ করে না। করতেও চায় না। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পে উপস্থিত শ্রোতাদের, ডোনারদের বার বার বলেছি- রক্ত একটা মহার্ঘ জিনিস। ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে সুদে-মূলে তার বৃদ্ধি ঘটে কিন্তু রক্ত এমনই একটি পদার্থ যার বৃদ্ধি শরীরে থেকেই বিনষ্ট হয়ে যায়। রক্ত দিলে শরীরে রক্তের ঘাটতি হয় না। নিজের বাড়ির রোগীর প্রয়োজনে নিজেদের রক্ত দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। মনে মনে এভাবেই আপনারা একটা শপথ নিন-‘আমাদের রোগীর প্রয়োজনে আমরাই রক্ত দেব।’যদি কোনও পাড়াতে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী থাকে, পাড়ার মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন নিয়ে একটা সহযোগী দল গঠন করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারা বছর ধরে ওই রোগীকে রক্ত দেবেন। এতসব বলেও কী আমরা সেই পরিমাণ মানুষের মধ্যে কোনও মানসিকতার বিকাশ দেখতে পাচ্ছি? এখনও এরা এখানে ওখানে রক্তের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সেই সুযোগে কিছু ডোনার অর্থের বিনিময়ে বাইরে রক্ত বিক্রি করছে। অমিত চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বলল, তুমি বিশ্বাস করবে না সোনালি, কিছু বেসরকারি ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক রক্তদাতাদের বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন দেখাচ্ছে। কেউ কেউ সেই প্রলোভনে পা দিচ্ছে। কোনও সংগঠক, ক্লাব –এদেরকে ক্যারাম বোর্ড, কালার টিভি, স্টীল আমমারি, পাখা পর্যন্ত দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া সারা বছর ধরে চলে। এভাবে ওরা একটা জাল বিস্তার করেছে এবং বিষয়টাকে একটা শিল্পের মানে ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে ফেলছে। বিপন্ন মানুষের কাছে ওই রক্ত চড়া দামে বিক্রি করছে। আর যদি রেয়ার গ্রুপের রক্ত হয়- তাহলে তো কথাই নেই। আমার ঠিকমতো জ্ঞান হওয়া থেকে লক্ষ করছি এই সমাজ ক্রম বর্ধমান পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। যত দিন যাচ্ছে মানুষের মন থেকে সহযোগীতার মানসিকতা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এরজন্য কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দ্বিচারিতা কাজ করছে। দলের লোক হলে সহযোগীতা পাবে, সুযোগ-সুবিধা পাবে। এটা সমাজের ক্ষেত্রে একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক দিক। অর্থলিপ্সা মানুষকে এতটা অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেবে কোনওদিন ধারণা করতে পারে নি অমিত। প্রাইভেট নার্সিং হোম থেকে শুরু করে ডাক্তারদের চেম্বার, প্যাথোলজি সেন্টার-প্রত্যেকটা জায়গায় ‘পরিষেবা’ দেওয়ার নামে টাকা রোজগারের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখন আবার প্যাকেজ সিস্টেম। অমিত বহুক্ষেত্রে দেখেছে প্যাকেজের টাকার তুলনায় আরও পাঁচ দশ হাজার টাকা বিলে অ্যাড হচ্ছে। এই নিয়ে অনেক তর্ক, বাক-বিতন্ডা হয়েছে। ক্যাশ কাউন্টারে বসা কোর্ট টাই পরিহিত অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা স্যার স্যার, ম্যাডাম ম্যাডাম সম্বোধন করে বোঝাবার চেষ্টা করেছে- কেন টাকার পরিমাণ বাড়ল। অমিত প্রেসক্রিপশন এবং বিল মিলিয়ে অনেক অসঙ্গতি দেখতে পেয়েছে। এই যদি নার্সিং হোমের অবস্থা হয় তাহলে মানুষ কার উপর ভরসা করবে। কার বিশ্বাসে সেখানে যাবে। তবু রোগ হলে আমাদের সেখানেই যেতে হয়। মানুষ স্বচক্ষে ভগবান দেখতে পায় না। ভগবান আছে কী নেই সে তর্ক আলাদা। তাতে অমিত নিজেও জড়াতে চায় না। কিন্তু মনুষ্যরূপী ভগবান বলতে সাধারণ মানুষ ডাক্তারবাবুদেরই মনে করেন। তিনি তাদের জীবন দেন। সেই ডাক্তারবাবুরাই যদি কসাইয়ের মতো আচরণ করেন তাহলে তাদের সমাজগত অবস্থানটা কোথায় এসে দাঁড়ায়। আর নার্সিং হোমের ব্যবসা- ওফ, সে আর এক যন্ত্রণার গল্প। সেদিন সকালে কার্তিকের ফোন পেয়েই নার্সিং হোমে এসে পৌঁছাল সাতটা দশে। এসে শুনল একটু আগে পেশেন্টকে আই সি ইউ-তে দেওয়া হয়েছে। কার্তিকের কাছ থেকে অমিত জানতে পারল, আজ ভোর রাত্রে ওঁর বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। স্থানীয় ডাক্তারবাবু বললেন নার্সিং হোমে ভরতি করতে। ডাক্তারবাবু কিছু বললেন? বলেছে ট্রিটমেন্ট চলছে। বেলা আটটায় ডিউটি চেঞ্জ হবে। অমিত এবং কয়েকজন বন্ধু নার্সিং হোমের বাইরে আসে। পাশেই ন্যাশানাল হাইওয়ে। হু হু করে ছোট বড় নানা ধরণের গাড়ি ছুটে চলেছে। সামনের একটা চায়ের দোকানে গেল চা খেতে। বেঞ্চে বসে সবে মাত্র চায়ে চুমুক দিয়েছে অমিত ঠিক সেই সময় একটি বছর বাইশ তেইশের ছেলে অমিতের কাছে এসে বলল, দাদা, আপনি এখানে? কার কী হয়েছে? অমিত ছেলেটিকে চেনার চেষ্টা করছে। আপনি আমাকে চিনবেন না দাদা। আমি আপনাকে চিনি। আপনি একজন সমাজকর্মী। সকলের বিপদে আপদে গিয়ে দাঁড়ান। সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। না, না, ওসব কিছু নয়। তুমি এখানে কী করছ? আমি এখানে ওয়ার্ডবয়ের কাজ করি। আমার নাম ফাল্গুনী। আমার এক বন্ধুর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে আজ ভোর রাত্রে এখানে ভরতি হয়েছে। আমি এসে শুনলাম তাকে আই সি ইউ-তে রাখা হয়েছে। বেড নম্বর কত? কার্তিক, তোর বাবার বেড নম্বর কত? কার্তিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, তা জানি না। মানে ওরা সেরকম কিছু বলে নি। ফাল্গুনী সব শুনে বলল, আপনার বাবার নাম কী? ভবতোষ ঘোষ। ঠিক আছে। আমি দেখে এসে খবর দিচ্ছি। কার্তিক বলল, সত্যি অমিতদা, তুমি আসাতে একজন পরিচিত লোক পাওয়া গেল। দেখা যাক, যদি ডাক্তারবাবুকে বলে- অমিত ফিরে আসতে গিয়েও ফিরতে পারছে না। বেলা এগারোটার সময় ডাক্তার ভিজিট। সেই সময় অবধি তাকে অপেক্ষা করতে হবে। চায়ের দোকানে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে পড়তে নিল। তখন প্রায় নটা দশ পনেরো হবে। হন্তদন্ত হয়ে ফাল্গুনী এসে অমিতকে খুঁজতে থাকে। অমিতকে চায়ের দোকানেই বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, একজন বন্ধুকে নিয়ে আমার পিছন পিছন আসুন। অমিত খবরের কাগজ রেখে পাপ্পুকে ডেকে নিয়ে ফাল্গুনীর পিছু নিল। একটু পরে ওরা এসে দাঁড়াল নার্সিং হোমের পিছনে। অমিতের সঙ্গে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে ফাল্গুনী বলল, উনি ভবতোষ ঘোষের ছেলে? না। ওকে ওখানেই দাঁড়াতে বলুন। উনি দেখবেন এই নার্সিং হোমের কোনও উর্দিপরা লোক যেন এদিকে না আসে। যদি কেউ আসে তাহলে আমাদের যেন ইশারা করে জানিয়ে দেয়। ফাল্গুনীর কথা শুনে অমিত ভাবছে মনে হচ্ছে কোনও ক্রাইম ঘটতে চলেছে। সাবধান করে দিতে চাইছে ফাল্গুনী। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। ফাল্গুনী ময়লা ফেলার ট্রলিটাকে আর একটু ভিতরে ঠেলে দিয়ে বলল, ব্যাপারটা খুব গোপনীয়। আপনার পরিচিত লোক বলেই বলে দিচ্ছি তবে আমার নাম প্রকাশ করবেন না। আপনারা পেশেন্টকে একবার দেখতে চাইছেন- এই অজুহাত দিয়ে ঢুকতে হবে। অমিতদা, আপনিই যাবেন ভবতোষ ঘোষের আত্মীয় সেজে। অমিত বুঝতে পারছে একটা ক্রাইম ঘটছে কিন্তু কী সেটা তখনও জানে না। ফাল্গুনী শেষ পর্যন্ত তাকে কী কথা শোনাবে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হতে থাকে অমিত। তবু সে মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, কেন? সব জানতে পারবেন দাদা। এই সব নার্সিং হোমগুলো হয়ে গেছে ব্যবসাক্ষেত্র। মরা মানুষকে তিনদিন ধরে আই সি ইউ-তে রেখে লাখ লাখ টাকা বিল করে ধরিয়ে দিচ্ছে। রোগীর পরিবার জমি বাড়ি বিক্রি করে সর্বসান্ত হয়ে যাচ্ছে। বলছ কী! বিস্মিত হয়ে পড়ে অমিত। ঠিক বলছি দাদা। আপনি অপরের জন্য কাজ করেন বলেই আপনাকে বলছি। সবাইকে বলতে গেলে একদিন ধরা পড়ে যাব। আমার চাকরি চলে যেতে পারে অথবা খুন করিয়েও দিতে পারে। তুমি আমাকে বলছ কেন? এটা তোমার কর্মক্ষেত্র। এখানে কাজ করে তুমি রোজগার কর। চোখে দেখে সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না অমিতদা। অমিত চোখের সামনে কোনও সিনেমা দেখছে। সে এই সবের কিছুই জানত না। ফাল্গুনীর কথা শুনে ভাবল, এটা যে কত বড় একটা ক্রাইম-, ও মাই গড। অমিতের মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। ফাল্গুনীর পরের কথা শুনে চমকে উঠল অমিত। দাদা, এবার আপনি সত্যের মুখোমুখি হন। আপনার বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। কী বলছ তুমি। কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল অমিত। ফাল্গুনী চোখ বড় করতেই অমিত নিজেকে সংযত করে চাপা স্বরে বলল, তুমি কী করে বুঝলে? আমি হাত দিয়ে দেখেছি। হাত পা সব ঠান্ডা। অমিত এই রকম একটা সত্যের মুখোমুখি হবে তা কখনও ভাবে নি। বহু মৃতদেহ দেখেছে। চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছে তাতে সে কোনওদিনও এইরকম শক পায় নি। এত ভয়ঙ্কর ঘটনা। মৃতদেহ নিয়ে বিজনেস! চোখে বিস্ময় জাগে অমিতের। ফাল্গুনী ফাঁকা ট্রলি নিয়ে ফিরে গেল। অমিত কার্তিককে অন্য রকমভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলল, আমি তোর মাসতুতো দাদা। অমিত রায় আমার নাম। বাইরে থাকি। খবর পেয়ে মেসোমশাইকে দেখতে এসেছি। তোরা রিসেপশনের কাছে থাকবি। একটু বাদে অমিত রিসেপশনিস্টের কাছে এসে জানতে চাইল- এক্সকিউজ মী ম্যাম, ভবতোষ ঘোষের বেড নম্বর কত? কাচের ওপারে বসে থাকা মহিলা কম্পিউটারের কী বোর্ডে চাপ দিয়ে দেখে বললেন, ওনাকে আই সি ইউ-তে রাখা হয়েছে। বেড নম্বর? সেভেন। ফ্লোর নম্বর- আপনি সেখানে যেতে পারবেন না। কেন? আপনি পেশেন্টের কে হন? উনি আমার মেসোমশাই। আমি কলকাতায় থাকি। খবর পেয়ে দেখতে এসেছি। আই সি ইউ-তে কাউকে অ্যালাও করা হয় না। আপনি এটা বললে আমি মেনে নেব কেন? আমি দেখব। আপনাদের ম্যানেজমেন্টকে খবর দিন। দেখুন মিস্টার- অমিত রায়। দেখুন অমিতবাবু, বুঝতেই পারছেন ওটা খুব সেনসেটিভ এরিয়া। আমরা কোনও ভাবেই অ্যালাও করতে পারি না। পারতে হবে। পেশেন্ট আমার। পেমেন্ট আমার। আমার দেখার অধিকার আছে। যদি আপনাদের কোনও অসুবিধা থাকে আমাকে বলে দিন, আমি বন্ডে সই করে পেশেন্টকে কলকাতায় নিয়ে যাব। রিসেপশনের মহিলা কী বুঝলেন কে জানে। তিনি বললেন, আপনি বসুন। আমি দেখছি। মিনিট তিনেকের মধ্যে ওই মহিলা দুজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসে অমিতকে দেখিয়ে বললেন, উনি। হায়, আমি শৌভিক। এখানকার ম্যানেজমেন্টে আছি। বলুন কী ধরণের হেল্প চাইছেন? আমি পেশেন্টকে একবার দেখতে চাই। আপনি সবই জানেন। ওখানে কাউকে অ্যালাও করা হয় না। ঠিক আছে। আপনি পেশেন্টকে রিলিজ করার ব্যবস্থা করুন। আমি নিয়ে যাব। এই অবস্থায় আপনি পেশেন্ট নিয়ে যেতে চাইছেন? জানেন, যে কোনও সময় পেশেন্ট এক্সপায়ার করে যেতে পারে। জানি। জানি বলেই শেষ দেখাটা দেখতে চাইছি। এখন উনি অনেকটা সুস্থ। আপনি আগামীকাল আসুন- অমিত এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। যেভাবেই হোক আজ এবং এখুনি তাকে দেখতে হবে। ভেতরের লোকের খবর। মিথ্যে হবে না। ডেড বডি রেখে ব্যবসা-। শুনুন, আমি আমার বক্তব্য বলে দিয়েছি। আপনাদের যেটা সুবিধা মনে হবে সেটা করুন। আমি পেশেন্ট দেখব নতুবা নিয়ে যাব। ছেলে দুটি নিজেদের মধ্যে ইশারা করল। তারপর শৌভিক বলল, ঠিক আছে স্যার, আপনি বসুন, আমরা দেখাবার ব্যবস্থা করছি। অমিত ওদের পিছু নিল। আপনাকে আসতে হবে না। আপনি বসুন। কল দিলে লিফটে চারতলায় চলে যাবেন। কোনও দরকার নেই। আমি সিঁড়ি দিয়েই যেতে পারব। শৌভিক পাশের ছেলেটিকে কিছু একটা ইঙ্গিত দিতেই ছেলেটি লিফটে চড়ে বসল। অমিত চারতলায় উঠতেই দেখতে পেল কেবিন। কেবিন পার হতেই ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। সে ভবতোষ ঘোষকে চেনে না। তবে বেড নম্বর জানে। সাত। অমিত কাচের জানালা দিয়ে ভিতরে চোখ রাখল। পর পর এক একটি বেডে এক একজন রোগী শুয়ে রয়েছে। সে বেড নম্বর গুনে গুনে দেখল সাত নম্বর বেডে একজন পুরুষ মানুষ শুয়ে রয়েছে। হাতে স্যালাইন, মুখে মাস্ক দেওয়া। পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। এবার চলুন স্যার। এই বলে শৌভিক পিছন ফিরতেই অমিত কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। এ কী করছেন আপনি? বাইরে আসুন। বাইরে আসুন বলছি। ভেতরে যে সমস্ত নার্স আর সিস্টার ছিল তারা অমিতকে ভিতরে দেখে ঘাবড়ে গেল। একজন মোটা করে নার্স এসে বলল- আপনি নার্সিং হোমের রুলস ব্রেক করেছেন। পুলিশে কল করছি। ধন্যবাদ। অমিত সাত নম্বর বেডের সামনে এসে দেখল স্যালাইন বোতল ফাঁকা। হাতে চ্যানেল আছে সূঁচ নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার তুলতেই বুঝতে পারল সেটাও ফাঁকা। বাহ, চমৎকার। সবটাই সাজিয়ে রেখেছেন পেশেন্ট পার্টিকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। কী বলতে চাইছেন আপনি- সেটা আপনারা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন। উনি তো মারা গিয়েছেন। হাত ধরে পার্লস পেলাম না। কী আজে বাজে বলছেন। উনি কোমায় আচ্ছন্ন। তার জন্য স্যালাইন, অক্সিজেন সব ফাঁকা থাকবে। কে বলেছে ফাঁকা। অক্সিজেন মাপার যন্ত্র নিয়ে আসুন। চেক করব। পুরো ম্যানেজমেন্ট ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তবু তারা না দমে বলল, আমরা ডাক্তার কল করছি। মনে হচ্ছে এই মাত্র এক্সপায়ারড করল। তাই নাকি। পোষ্ট মর্টেম করলে সেটা ধরা পড়বে তো। আপনাদের এগেনস্টে থানায় ডায়রি করে প্রাইভেটে পোস্ট মর্টেম করাব। সত্যি মিথ্যে সব ধরা পড়ে যাবে। দাঁড়ান তার আগে মিডিয়াকে একটু ফোন করে দিই। এই বলে অমিত মোবাইল বের করতেই- শৌভিক অমিতের হাত ধরে বলল, স্যার, বাইরের ঘরে চলুন। এখানে আরও পেশেন্ট আছে। তাদের যদি- আমি প্রতিটি পেশেন্টকে চেক করব। দেখব তারা কে কেমন অবস্থায় আছেন। স্যার, ওদের সবার ট্রিটমেন্ট চলছে। মা কসম বলছি। আপনি চলুন। প্লীজ স্যার। অমিতকে পাশের ঘরে বসিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নার্সিং হোমের বিল না নিয়ে ওরা ভবতোষ ঘোষকে ছেড়ে দিল। বাইরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। প্রকৃতির বুকে এখন অস্পষ্ট আলো দেখা যাচ্ছে। ট্রেন কম্পাটমেন্টে আলো জ্বলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ট্রেনের গতিবেগে এক একটা স্টেশন দ্রুত গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে সোনালি, এষা, বাবা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলল। আজ তেরো চোদ্দ দিন ঘর ছাড়া। মেয়েটাকে কতদিন দেখেনি। মা বাবা মাঝে মধ্যে বলে- ঘরের জন্য একটু সময় দে। আমাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। কোনদিন কী ঘটে যায় কে জানে। যখন আমাদের কিছু হল দেখা যাবে তুই ঘরে নেই। অমিত মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- মা, সোনালি স্কুল চাকরি পাওয়ার পরেই আমাকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। জাস্ট একটা ফোন। হ্যাঁ। তুই থাকবি কলকাতায়। খবর পেয়ে আসতে আসতে সব শেষ। বালাই ষাট। ওকথা বল না। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আগামীকাল ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে পৌচ্ছে যাবে। এই সব কাজ করতে গিয়ে কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয়। তাদের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে যায়। ভেলোর যাওয়ার প্রায় একমাস আগের ঘটনা। অমিত সবে মাত্র কার্জন গেট পার হয়েছে কি হয় নি- ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোটর বাইক রং রুটে এসে একজনকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল। এদিক ওদিক থেকে কত লোক ছুটে এল। কিন্তু কেউ সহযোগীতার হাত বাড়াতে চাইছে না। এদিকে লোকটা ছিটকে পড়ে যাওয়াতে যন্ত্রনায় ছটফট করছে। অমিত সময় নষ্ট না করে লোকটাকে পাঁজাকোলা করে রিক্সাতে চাপিয়ে সোজা হাসপাতাল। সে জানে এক মিনিটের জন্য হলেও মানুষ প্রাণে বেঁচে যেতে পারে। এমার্জেন্সিতে ভীড় একটু কম। প্রায়ই যাতাযাতের ফলে অনেক ডাক্তার সিস্টার নার্স- এরা অমিতকে চিনে গিয়েছে। অমিতের নিয়ে আসা কেস বলেই পুলিশও ছেড়ে দিল। শুধু এটুকু বলল- পরে এসে একবার দেখা করবেন। অমিত নীচে আসবে কী। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট দেখেই একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে বলল- এগুলো নিয়ে আসুন। অমিত নীচে নামতেই এক কনস্টেবল বলল, কী মশাই পালিয়ে যাচ্ছেন। অমিত কনস্টেবলটির চোখের উপর চোখ রেখে বলল, আমি কী চুরি করেছি যে পালিয়ে যাব। দেখতে পাচ্ছেন না হাতে পেসক্রিপশন। ওষুধ আনতে যাচ্ছি। কনস্টেবলটি তখন আর কিছু বলল না। কিন্তু এর প্রায় আধঘন্টা বাদে অমিত নীচে এসেছিল পেচ্ছাব করতে। সেই কনস্টেবল। এবার জিজ্ঞাসা করল- কী নাম? অমিত রায়। বাড়ি কোথায়? পশ্চিম রেলগেট। অ্যাকসিডেন্টটা কী আপনি করেছেন। না। তাহলে আপনি ওখানে কী করছিলেন? অমিত বুঝতে পারল এ এখানে নতুন। এখানে যারা ডিউটি দেয় তারা সকলেই কম বেশি তাকে চেনে। অমিত আর ওই রকম জেরা করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে এইরকম কত করেছে কতবার এখানে এসেছে সব বলল। কনস্টেবলটি সব শুনে বলল- একপ্রকার ঠিকে নিয়েছেন দেখছি। তা বলতে পারেন। এটা হল অঘোষিত পরোপকারের ঠিকে নেওয়া কিন্তু যারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঠিকে নিয়ে বসে থাকে তারা কী সত্যি সত্যিই মন থেকে গরীব বা দুঃস্থ মানুষদের জন্য কিছু উপকার করে? তারা কী ভাবে সেইসব মানুষগুলো কীভাবে একটু খেয়ে পরে বাঁচবে। সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের আখেড় গোছাবার কাজ করে। কী বলতে চাইছেন আপনি? একটু ধমকের সুরেই কথাটা বলল। অমিত মনে মনে ভাবল পুরোপুরি মাথার উপর দিয়ে যায় নি। অ্যান্টেনা একটু হলেও ক্যাচ করেছে। অমিত একটু টোন দিয়ে বলল- কেন বুঝতে পারলেন না, নাকি না বোঝার ভান করছেন। আপনার গায়ে রাষ্ট্রের দেওয়া পোষাক- এই পোষাককে কতটুকু সম্মান দেন? সে আমতা আমতা করতে থাকে। ঠিক সেই সময় ওখান দিয়ে একজন ডাক্তারবাবু যাচ্ছিলেন। তিনি অমিতকে দেখে বললেন- কেমন আছেন। অমিত হেসে বলল, ভাল। এই মাত্র একজনকে নিয়ে এলাম। ভালই করেছেন। আপনাদের মতো কিছু লোক না থাকলে সমাজের এই কাজগুলো কে করবে বলুন। আসছি। এদিকে রোগীর বাড়ির লোকজন এসে যাওয়াতে অমিত হাসপাতাল থেকে রওনা দিল। পাশেই চায়ের দোকান। একটা বিস্কুট আর এক কাপ গরম চা নিল। চা খেয়ে দাম দিতেই দোকানদার বলল, দাম দিতে হবে না। সেকি! কেন? আপনি লোকের জন্য যা করেন আমি তো অত করতে পারব না। তাই ভালবেসে আপনাকে আমি চা খাওলাম। ওইটুকু পয়সার জন্য এই চাওয়ালা ভাইটা গরিব হয়ে যাবে না দাদা। মোবাইল থেকে অ্যালার্মের শব্দ হতেই ধড়ফড় করে উঠে বসল অমিত। মোবাইল অফ করে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে মুখ রাখল। বাইরের আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। সে উঠে পড়ল। বাথরুম থেকে চোখমুখ ধুয়ে শিবুদাকে ডেকে বলল- রেডি হয়ে নাও। আর একটু পরেই হাওড়া পৌঁছাব। অমিত নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ভেলোরের হাসপাতালটির কথা ভাবছিল। হাসপাতাল দেখলেও মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। কত সুন্দর ব্যবস্থাপনা। কী সুন্দর ট্রিটমেন্ট। ডাক্তারবাবু থেকে ওয়ার্ড বয়- এদের ব্যবহারে অর্ধেক রোগ সেরে যায়। মা বাবা ছাড়া ডাক নেই। মাথায়, গায়ে হাতে সর্বদা স্নেহের পরশ মেশানো। শিবুদার বৌয়ের একটা কিডনি বাদ দিল। টেষ্ট থেকে শুরু করে মেডিসিন পর্যন্ত। তারপর ও টি। পেশেন্টের সঙ্গে সব সময় শিবুদাকে রেখেছে। আর কলকাতা বর্ধমান সেগুলোও নার্সিং হোম কিন্তু তফাত অনেক। যাওয়া-আসা, থাকার জন্য যদি একটু খরচ করে- তাহলে অমিতের মনে হয় বড় বড় অপারেশনগুলো পশ্চিমবঙ্গে না করিয়ে এখানে আনা সবচেয়ে বেটার। তবে সঙ্গে একজন লোক থাকা প্রয়োজন। সেই লোক পাওয়াই বড় সমস্যা। কেউ এগিয়ে আসে না, আবার কাউকে বললে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। শিবুদা বলল- এই যে গেলাম। খরচ হল এটা ঠিক কিন্তু মাইন্ড স্যাটিসফায়েড। ওখানে যদি কারও অঘটন ঘটে যায় তবু মনকে সান্ত্বনা দিতে পারবে। অমিত চায়ের কাপ ফেলে নিজের ব্যাগ কাঁধে তুলে বলল, শিবুদা, আসছি। বৌদি এলাম। পরে দেখা করব। শিবু অমিতের হাত ধরে বলল, তুমি সঙ্গে না থাকলে একা থতমত খেয়ে যেতাম। আবার ওসব কথা। এই যুগে অপরের জন্য বিনা স্বার্থে এইটুকুওবা কে করে? ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি বৌদির দিকে একটু কেয়ার নিও। ডাক্তারবাবুর সাজেশন মতো চল। আর ইমিডিয়েট একটা রান্না করার লোকের ব্যবস্থা করে নাও। আসছি। অমিত বাড়ির দিকে পা বাড়াল। মনে মনে ভাবল- মানুষ হিসাবে মানুষের জন্য যদি এইটুকু নাই করলাম তাহলে মানব জনম কেন? যারা মানুষ হয়েও পশুর মতো জীবন কাটায় তাদের লজ্জা হওয়া উচিত। এই সমাজ থেকে সব কিছু নিয়ে এই সমাজের উপকারে সে যদি না এগিয়ে আসে বা সমাজের জন্য কোনও কন্ট্রিবিউট না করে তাহলে তাদের বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে অমিত বাড়ির দরজার কলিং বেল-এ হাত রাখল।

read more
            
পাবলো নেরুদা সুজনেষু
...
বিশ্বজিৎ বিশ্বাস

পাবলো নেরুদা সুজনেষু বিশ্বজিৎ বিশ্বাস সত্যের সঙ্গে কড়ার করেছিলে এই জীবন্ত গ্রহে, আবার এনে দেবে আলোর নির্যাস, চেয়েছিলে হতে অন্নের মতন, সংগ্রামে তুমি নেই হয়েছে কি কখনও এমন, আর যা কিছু ভিজিয়েছ আপন হৃদয়ের কষে তুমি এখন তার ঠাঁইতে, হারানো নির্জনতার মাঝখানেরও মাঝখানে , এই পাথরের কোল ছুঁয়ে নাই বা নেমে এলো ঘুম চোখের পাতায়, তোমার নৈঃশব্দের মধ্যে নিয়ত গড়িয়ে চলেছে নীল পানির ধারা, ,,,,,,,,, ,,,,,,,

read more
            
হে বীর তুমি ...
...
সিপ্তি সরকার

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জন্য প্রবাহমান গদ্য কবিতা: হে বীর তুমি ... কলমে: সিপ্তি সরকার ***************************** ভারত স্বাধীনের দেশপ্রেমিক ছিলেন যত, আত্ম ত্যাগ মহান বিপ্লবী হে বীর তুমি। দেশের ভয়ানক অত্যাচারের প্রতিবাদে রূঢ় কন্ঠে ধ্বনিত হলো -- ব্রহ্মজ্ঞানী নানান ছদ্ম বেশে , দেশের নায়ক স্বাধীনতার সাফল্যে পরাস্ত হয়েছিল ব্রিটিশ সম্রাজ্য , জয়ের ধ্বনি হে বীর তুমি... সততা , নৈতিকতা ও মানবিকতা দিয়ে, শ্রেয় ছিলে অসহায়কের পাশে, শত দ্বন্দ্ব ও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও তোমার বীরত্ব হয়নি নত। তুমি উন্নত বীর উচ্চ শৃঙ্গের ন্যায় উন্নত শির , ভারতবর্ষের আসমুদ্র হিমাচল একটিই মন্ত্র 'জয় হিন্দ' - গড়ে উঠলো 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' । ধ্বনিত হলো 'নেতাজী সুভাষ জিন্দাবাদ '। একদিকে তোমার বিপুল জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে স্বার্থাম্বেষী আহাম্মকের দল! বিশ্বখ্যাত সত্য স্বরূপ 'অমর ' বীর তুমি l সুযোগ সন্ধানী কিছু হিতাকাঙ্খী ছদ্মবেশী - ফন্দিফিকির ছল-কৌশলে চালাচ্ছে লুন্ঠনরাজ। তোমার গড়া স্বাধীন দেশে ঘটছে অবনতি ! চতুর্দিকে আনাচে কানাচে ভরেছে মানুষের অন্তরে বিষে-বিষ l ক্রোধে আজ সুশীল সমাজ ? কি তার কারণ? একি শুধু যন্ত্র-না ! নাকি উদ্দেশ্য পুরণ!... হে বীর আজ তোমায় খুব প্রয়োজন। ----------*----------

read more
            
প্রাণের ভাষা
...
সিপ্তি সরকার

কবিতা: প্রাণের ভাষা নাম: সিপ্তি সরকার ********************** আমরা বাঙালী বাংলা আমার প্রাণ , যে ভাষাতে জন্ম আমার করেছে প্রাণ- দান l ঐক্য মোদের রক্তে ভাসে জীবন প্রদীপ জ্বালি , সত্য ব্রতে - জ্ঞান ব্রতে আমরা বাঙালী l বিশ্ব মাঝে সবার সেরা কবি গুরুর গানে ভরা অম্লান রক্তকরবী , হাজার ভাষার মাঝে আমরা জীবন্ত নবি l বাংলা আমার গর্ব , আমার স্বপ্নে ছেঁড়া বাঁধ , সবার 'পরে আমার ভাষা থাকুক, আমার সাধ l

read more
            
কবিতা
...
কানাই লাল বিশ্বাস

কবিতা কানাই লাল বিশ্বাস কবিতা আমার গ্রহের আলো কবিতা আমার শেকড়ের জল, কবিতা আমার সমাজ দর্পন কবিতা আমার জীবন দর্শন, কবিতা আমায় বাঁচতে শেখায় কবিতা আমায় লড়তে শেখায়, কবিতা আমায় বলতে শেখায় কবিতা আমায় চলতে শেখায়, কবিতা আমাকে মানুষ চেনায় কবিতা আমাকে সমাজ বোঝায়, কবিতা আমাকে জীবন চেনায় কবিতা আমাকে সময় জানায়, কবিতা কাঁটাতার যুদ্ধাস্ত্র মুক্ত বিশ্ব কবিতা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বিশ্ব, কবিতা ধর্ম রাষ্ট্র পুঁজিমুক্ত বিশ্ব কবিতা ছাড়া সবই তো নিঃস্ব, ,,,,,,,,, ,,,,,,

read more
            
পুষ্ট
...
কানাই লাল বিশ্বাস

পুষ্ট কানাই লাল বিশ্বাস এইযে এত বিশাল বিশাল অট্টালিকা, অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, আরও আরও কত কি বিশালাকার,,,,, বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি সাধনে রোবটকে দিয়ে অনায়াসেই নানান কাজ করিয়ে নেওয়া,,,,,, প্রকৃতি পরিবেশ সবুজতা হারিয়ে ক্রমশই গাঢ় কালো আকার নিচ্ছে,,,,, গণতন্ত্র,সমাজবাদ এখন ধনবাদের মাতব্বরদের কাছে বন্ধক রেখেছে সর্বহারার মহান‌ নেতারা,,,,,,,, জাত, ধর্ম,গোত্র, বর্ণের পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠার আগেই সশস্ত্র মুক্তিদাতারা চমকে ধমকে,,,,,,,, যাবতীয় অন্ধকার তবু দূরে সরে যাবেই যাবে,আলো আরও আরও কাছে আসবে,,,,, আগামীদিনে কালোরঙা পৃথিবীকে সবুজ হতেই হবে,,,,, শ্বাসবায়ূ, পানীয় জল, চাষযোগ্য মাটি না টিকে থাকলে কি করে আর টিকে থাকে বলো সাধের মানবসমাজ,,,,,,, দূষনের দ্রুতগতি না রুখলে অকালমৃত্যু রুখবে কি করে,,,,,, প্রকৃতি, পরিবেশ,বিশ্বসম্পদ,মানবসম্পদ,যেখানে যে যাই বলো না কেনো ,সবই প্রকৃতি মাতার মানব সন্তানদের মেহনতে, রক্তে,ঘামে ভিজে নেয়ে ক্রমশ ই পুষ্ট হচ্ছে,,,,, ,,,,,,,,,, ,,,,,,,,

read more
            
নীরব দর্শক
...
কানাই লাল বিশ্বাস

* কানাই লাল বিশ্বাস* তোমরা যখনই হাতে গাছের চারা না নিয়ে মারনাস্ত্র তুলে নাও অতি অনায়াসেই, তখনই অতি মনোরম বিশ্বের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে,,,,, মনুষ্যত্ব বেমালুম জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুই দম দেওয়া পুতুলের মতো আওড়ে যাওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়াও, মানুষের পাশে থাকো, মানুষের কথা শোনো,এসব শুধুই কথার কথা,,,,, ধর্মাচাষী, রাজনৈতিক মাতব্বর, পুঁজির কারবারি,মেকি মৌখিক সৌখিন নিস্ক্রিয় সমাজবাদীরা সুকৌশলে বিশ্বনাগরিকদের শুধুই অর্থ রোজগারের যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে,,,,,, সশস্ত্র বাহিনী যখন সৃজনশিল্পীদের সমাজ সভ্যতা, সংস্কৃতি ধ্বংসে মেতে থাকে , নিরস্ত্র বাহিনী তখন পরোক্ষে কখন যেনো ধ্বংসকারী অমানুষদের হৈ হুল্লোড়ে সায় দিয়ে দেয়,,,,, সমাজবিপ্লবীদের রক্ত ঝরানো ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে তিলতিল করে গড়ে ওঠা সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি বেমালুম ধ্বংস হয়ে যাবে যেনেও ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী বেহুঁশ মানুষদের ভয়ে মান হুঁশ মানুষেরা কেমন যেনো সবসময়ই মুক বধিরের অভিনয় করে চলেছেন অবিরত ,,,,,,, সমাজশিল্পীদের থেকেও অন্ধকার জগতের অর্থবানেরা মঞ্চ আলো করে প্রতিনিয়ত ভুলভাল বকে গেলেও অনেকেই আমরা কি সুন্দর সুখিসুখি মন আর খুশিখুশি ভাব করে সময় কাটিয়ে দিই,,,,, সভায় সভায় সঞ্চালকেরা নিরুপায় হয়ে ধ্বংসকারীদের হয়ে গুনগান গেয়ে তাবেদারি করে যান আর হ্যা বলা সঙেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে কি করবে ভেবেই পায়না,,,,,,, ব্রুনোরা আজও পুড়ে পুড়ে যান আর দাঁত বের করা , কার্টুন মানুষ, বহুরূপী মানুষ, বেহুঁশ মানুষেরা ভয়ঙ্কর খুনিদের আহ্লাদিতভাবে সমর্থন জুগিয়ে যান,,,,,, অসহ্য লাগলেও মুখ বুজে থাকতে থাকতে,,,,,, বিশ্বের সমাজ সৃজনশিল্পীদের কান্নার জলে চোখগুলো একইভাবে ভিজে ভিজে যায়,,,,, ,,,,,,,,,,, ,,,,,,,,

read more
            
কবিতা : প্রবীণের আত্মকথা
...
সিপ্তি সরকার

কবিতা : প্রবীণের আত্মকথা কলমে: সিপ্তি সরকার ******************************* তিনি আজ বৃদ্ধ হলেন, শুদ্ধ ভাষায় প্রবীণ হলেন। বহু বছর ছত্রছায়ায় অনেককেই - আগলে রেখে ছিলেন, সেই সময় ব্যস্ততার সীমায় গোড়ালি ডুবেছিল। বাকী সকল নবীনেরা পাটাতনে থেকে- বিশ্বকে ভ্রমণ করেছিল। আজ তারাই দেখো ব্যস্ত কত! প্রবীণ মানুষ আপন মনে একা ঘরের কোণে, জানালাটাই উঁকি দিয়ে - আকাশ দেখেন স্বপ্ন বুনেন যত! সকলেই তাঁর পাশ থেকে চলে যায় তিনি অবলীলায় অবলোকন করেন। আজ তাঁর ক্ষমতাহীন,শক্তিহীন শরীর..! কোনও প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে হয়না, সময়ের সময়েই তিনিই প্রশ্ন করবেনও ভাবেন - অথচ সময় কখনও আসেনা! এখন তিনি প্রবীণ থেকে আরও আরও প্রবীণ হচ্ছেন..! সময়কে তিনি এগিয়ে যেতে দেখেন দেখেন সময় যে থামেই না, সেই সঙ্গে তিনিও - ফুরিয়ে যেতে থাকেন, এই না দেখে কারোর কিছু যায় আসেনা। প্রবীণ মানুষটি একাকিত্বে বড় অসহায় ভাবে - দেওয়ালের সাথে কত কথায়না বলেন!! স্বয়ং ভগবান অলক্ষে দাঁড়িয়ে বোধহয় তাইনা দেখে তখন মুচকি দিয়ে হাসেন। ---------*--------

read more
            
ধর্ম্মমঙ্গল ও রাঢ় সংস্কৃতি ।
...
সুমনা বসু

সুমনা বসু গ্রাম দেবতার প্রাধান্য বাংলার নিজস্ব মৌলিক সংস্কৃতির অঙ্গ । রাঢ বঙ্গে গ্রামের অধিদেব হলেন ধর্ম্মরাজ। তাঁর সঙ্গীনী হলেন দেবী মনসা। কোথাও কেতকা, বিশালাক্ষী, আবার কোথাও চন্ডী বা ষষ্ঠি নামেও পুজিত। ধর্ম্মরাজ ই প্রধান গ্রাম দেবতা ছিলেন। কারণ তিনি রাজ শক্তির প্রতীক।মল্লসারুল তাম্রপট্টের উপরে মহারাজা বিজয় সেনের সীল আছে। সেই সীলে যে মূর্তি আঁকা আছে তা ধর্ম্মরাজের মৃর্তি বলেই মনে করা হয়। তাম্রপট্টের প্রথম শ্লোকে ধর্মঠাকুরের ই বন্দনা আছে। এবং এই সীল থেকে ই প্রমাণ হয় যে ধর্ম্মঠাকুরের প্রভাব প্রতিপত্তি কত টা ছিল। ধর্ম ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচারে লেখা ধর্ম্মমঙ্গল কাব্য, মঙ্গল কাব্য ধারায় সবথেকে নবীন। শুধু ধর্ম্মমঙ্গল নয়, সবকটি মঙ্গল কাব্য সহ বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন , মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় , চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্যোত্তর যুগের পদাবলী কাব্য থেকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় আচার,আচরণ,ও বাঙালির জীবনচর্যার ও সংস্কৃতির চিত্র পাওয়া যায় । সমাজ বিবর্তনের সাথে সাহিত্য অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত । বলা যায় একে অপরের পরিপূরক । রাজায় রাজায় যুদ্ধ, সিংহাসন দখল করাই ইতিহাস নয়। সময় সাপেক্ষে জনগোষ্ঠীর সভ্যতার বিবর্তন, জীবন যাপন পদ্ধতি, আর্থ সামাজিক অবস্থা সব কিছুরই বহমান প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সাহিত্য দর্পণে। আর এই দিক থেকে মঙ্গল কাব্য গুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন । মঙ্গল কাব্য কে রাঢ়ের জাতীয় কাব্য বলা হয়। কারণ এই কাব্যে বিশ্ব জনীনতার ছবি ফুটে উঠেছে। শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে কেন্দ্র করে যেমন কাটোয়া কালনা এই সব গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল গুলিতে যেমন একটি বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে, সেখানে চৈতন্য পার্ষদ ও জীবনীকার ও পদকর্তাদের জন্ম হয়েছে তেমনি রাঢ় বঙ্গে, বিশেষ করে রাঢ়ের দক্ষিণ অংশে মঙ্গল কাব্যের কবিদের জন্মস্থান । এটা শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয় ।ইতিহাসের ক্ষেত্রে ও গভীর তাৎপর্য পূর্ণ। এই রাঢ়ের দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাতেই বহিঃশত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদি অধিবাসীরা তথা বোড়ো, শবর, কিরাত,হাড়ি,ডোম মুচি, বাগদি এরা বাসস্থান গড়ে তুলেছিল। এবং তারা ধর্ম, চন্ডী, মনসা, প্রভৃতি অচ্ছুত অনার্য দেব দেবীদের পুজো শুরু করে। পুজো উপলক্ষে গাজন,সয়লা, ভাদু, টুসু, পুন্যিপুকুর, সাঁঝ পুজনী এই সব লৌকিক আচার পরব পালন শুরু করে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে রাঢ় হল লোক সংস্কৃতির আতুড় ঘর। আঞ্চলিক ইতিহাস ও জনজাতিগুলির ঐতিহ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের শিকড়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতাপ, প্রতিপত্তি, আচার সর্বস্বতা হত দরিদ্র হিন্দুদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিল। তফশিলি, আদিবাসী শ্রেণীর মানুষরা জীবন যাপনের তাগিদে ধর্মান্তরিত হয়েছে। সেই সময় সব শ্রেণি ও সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে মেল বন্ধনের জন্য দক্ষিণ দামোদরের কয়েকজন কবি অচ্ছুত দেব দেবীদের পুজো কে সর্বজনের করে তোলার উদ্দেশ্য ই লিখেছিলেন মঙ্গল কাব্য । এই সব কবিরা হলেন মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী । ধর্ম ঠাকুর লোক দেবতা। ঠাকুরের মূর্তি বলতে একখণ্ড পাথর। কোথাও ডিম্বাকৃতি, কোথাও কুর্মাকৃতি কোথাও আবার চৌকো কালো পাথর। পিতলের অথবা রুপোর আয়ত চোখ ও বসানো থাকে। এই ধর্ম ঠাকুর ধর্মরাজ,ধর্মরায়, বাঁকুড়া রায়, দামোদর রায় , যাত্রা সিদ্ধিরায়, পোড়া রায়, শ্যামরায় এমন বহু নামে সুজিত হন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ধর্ম ঠাকুর বৌদ্ধ ত্রিরত্নের মধ্যম রত্ন । বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি । এই ধম্মং শরণং থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের পরিবর্তিত রূপ হয়ে বাংলায় ধর্ম ঠাকুরের উৎপত্তি । আবার সুনীতি কুমারের মতে ধর্ম ঠাকুর হলেন কুর্ম অবতার। কেউ কেউ মনে করেন অনার্য রা যে সূর্য পুজো করতেন তিনি ই কলক্রমে ধর্মরাজে রূপান্তরিত হয়েছেন যাইহোক ধর্ম ঠাকুর লৌকিক দেবতা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই । প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন গ্রামে ধর্ম রাজের পুজো হয়। পুজোতে পাঁঠা, হাঁস, মুরগী, পায়রা, শূকর বলিও দেওয়া হয় বলে জানা যায় ।এবং ধর্ম ঠাকুরকে কেন্দ্র করে আর্য অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় । ধর্ম্মমঙ্গল কাব্য মঙ্গল কাব্য ধারা য় নবীনতম সংযোজন। মঙ্গল কাব্য ধারায় দুটি শাখা। ক) প্রধান খ) অপ্রধান । ক)প্রধান_ ১] মনসামঙ্গল ২] চন্ডী মঙ্গল ৩] ধর্ম মঙ্গল খ) অপ্রধান_ ১] অন্নদামঙ্গল ২] দুর্গা মঙ্গল ৩] শিবমঙ্গল ইত্যাদি ইত্যাদি । 'বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস' গ্রন্থে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন _ মধ্যযুগের বাংলার জলবায়ু তে দেশীয় লৌকিক সংস্কারের সাথে ব্রাহ্মণ সংস্কার যে কিভাবে একদেহে লীন হয়ে আছে মঙ্গল কাব্য গুলি তাহার ই পরিচয়। মঙ্গল কাব্যের আলোচকদের মত অনুযায়ী মঙ্গল কাব্য হল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য । জাতীয় কাব্য বলতে আমারা বুঝি যে সেই কাব্যের মধ্যে ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, রাজনৈতিক জীবন প্রতিফলিত হবে। জনজীবনের সংস্কৃতি, জীবন যাপন, সুখ দুঃখ সব ই চিত্রিত হবে। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে ধর্ম মঙ্গল কাব্য একটু স্বতন্ত্র অবস্থানে আছে। দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারে লেখা হলেও ধর্ম মঙ্গল কাব্য বাস্তবমুখী হয়ে উঠেছে । চব্বিশ পালায় বিভক্ত দীর্ঘ এই কাব্যে অনেক ঘটনার সমন্বয় দেখা যায় । সাধারণত মঙ্গল কাব্য গুলিতে অলৌকিকতার প্রাধান্য দেখা যায় । করুণ রস ও বীর রসের আশ্রয়েই মঙ্গল কাব্য রচিত হতে লক্ষ্য করা যায় । কিন্তু মনসা মঙ্গল ও চন্ডী মঙ্গল থেকে ধর্মমঙ্গলের কাহিনি বিশাল। প্রধানত বীর রসের আধারেই এই কাব্য রচিত । বলা যায় মধ্য যুগের ইতিহাসের একটি বীরত্বপৃর্ণ কাব্যিক প্রকাশ হল ধর্ম মঙ্গল কাব্য। সেই সঙ্গে শৃঙ্গার ও করুণ রসের প্রকাশ ও দেখা যায় । ধর্ম মঙ্গল কাব্যে রাঢ় অঞ্চলের অবলুপ্ত ইতিহাসের প্রক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায় । এই কাব্যে এই কাব্যে উল্লিখিত ঘটনা চরিত্র স্থান ও নদীর নামের সাথে রাঢ়ের ইতিহাসের যোগ আছে। স্থানীয় যে জনপদ ও নদ নদীর নাম আছে তা একেবারেই রাঢ় অঞ্চলের। যেমন বর্ধমান, মন্দারণ, উচালন, মঙ্গলকোট ইত্যাদি জনপদ ও দামোদর, অজয়, দারিকেশ্বর ইত্যাদি নদী র নাম আছে। ধর্ম মঙ্গল কাব্যের একাধিক কবি র ও নাম পাওয়া যায় । ময়ূরভট্ট, মানিকরাম গাঙ্গুলী, রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী । এই কবিরা সকলেই রাঢ় বঙ্গের । এদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী র ধর্মমঙ্গল কাব্য অধিক প্রচলিত । এর একটা কারণ অবশ্য আছে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বিভাগে এটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত । তাই ছাত্রমহলে এর গুরুত্ব অবশ্যই আছে। বর্ধমান রাজসভার কবি ছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী । রাজা কীর্তিচাঁদ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এই কাব্য লেখেন । ধর্মপুরাণ _ ধর্ম রাজের পুজো উপলক্ষে ধর্ম পুরাণ পাঠ হয়। ধর্ম পুরাণ কিন্তু ধর্ম মঙ্গল কাব্য পাঠ নয়। এটা আমাদের ধারণা হতে পারে যে দুটি একই। কারণ মধ্য যুগে মঙ্গল কাব্য গুলি গাওয়ার জন্য ই লেখা হত।ধর্ম পুরাণ হলো ধর্মমঙ্গল কাব্য বর্ণনা ও সেই কাহিনি অনুষঙ্গে গান গাওয়া । এখানে ধর্ম মঙ্গল কাব্য সুর করে পাঠ হয় না। যেমন টা মনসা মঙ্গলের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আগেই বলেছি ধর্ম মঙ্গল কাব্যের কাহিনি পরিসর বিরাট। ঘটনা কে নিজের মতো করে বর্ণনা করেন গায়েন। ও সেই ঘটনার স্হান, কাল , সময় অনুযায়ী নির্দিষ্ট রাগে গান ধরেন। এটাকেই ধর্ম পুরাণ পাঠ বলে।একজন মূল গায়েন থাকেন । বাদ্যযন্ত্রে আরো চারজন থাকেন। বাদ্যযন্ত্র বলতে হারমোনিয়াম, খোল, খঞ্জনি, ক্যাসিও ইত্যাদি । মূল গায়েনর সাথে ধৃয়াপদ গুলিতে যন্ত্রশিল্পীরা ও গলা মেলান। গান গুলির কথা ও সুর ধর্ম পুরাণ পাঠের গায়েন দের নিজেদের । অর্থাৎ গায়েনের দল পাল্টে গেলে গান গুলির কথা ও সুর আলাদা হয়ে যায় । এটা গায়েন দের নিজেদের ই স্বীকারোক্তি । বাপ ঠাকুরদার কাছ থেকে শুনে শুনে তারা এই ধর্ম পুরাণ পাঠ শিখেছে পরম্পরাগত ভাবে। বাংলার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই রকম ধর্ম পুরাণ পাঠের দল অনেক আছে। যাঁরা বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় পাঠ করে বেড়ান। পেশাগত ভাবে তারা সেই অর্থে শিল্পীর স্বীকৃতি পান নি। মূলত কৃষি জীবী, শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ এরা। প্রান্তিক এই মানুষদের ধর্ম পুরাণ পাঠ না শুনলে সত্যি ই বিশ্বাস করা কঠিন । এতবড় কাব্য, চব্বিশ টি পালা, এত চরিত্র ক্রম অনুযায়ী তারা কাহিনি বর্ণনা করে গান গেয়ে থাকেন ।কাহিনির স্থান কাল সময় অনুযায়ী রাগ রাগিনী উল্লেখ ও থাকে। যেমন উদাহরণ হিসেবে আমার ক্ষেত্র সমীক্ষা র সময় নথিভুক্ত করা কয়েকটি গানের উল্লেখ করলাম । হনুমান ধর্ম রাজের আদেশে ইন্দ্রকে গিয়ে বলেন চার মেঘ ও চৌষট্টি মেঘিনী কে গৌড় রাজ্য ভাসাতে পাঠাতে হবে । এই প্রসঙ্গে গান _ 'মেঘ নেমেছে তরুতলে '..... রাজ্যে মড়ক লাগলে গৌড়রাজ ধর্ম রাজকে প্রার্থনা করেন 'নারায়ণ হরে..... জয় দেব দেব হরে ' বার বার এই কাব্যে হনুমান প্রসঙ্গ আসে। যদি ও ধর্ম ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার এর উদ্দেশ্য কিন্তু হনুমান, দুর্গা , কালি ঠাকুরের উল্লেখ বার বার করা হয়েছে। হনুমান প্রসঙ্গে একাধিক বার জয় রাম... শ্রী রাম গান ও শোনা যায় ।পশ্চিম উদয় পালায় স্ত্রী, কলিঙ্গা ওকানাড়া থেকে বিদায় নিয়ে লাউসেন হাকন্দে যায় সূর্য পশ্চিম উদয়ের, জন্য ধর্ম রাজের তপস্যা করতে। তখন অমলা, বিমলা, কলিঙ্গা কাঁদতে কাঁদতে গান করে বলে ' রমনীর পতি বিনে বলো কি আর আছে ' মূলত এটি স্বামীর বন্দনা সূচক গান। এবং এই প্রসঙ্গে গায়েন সাবিত্রী সত্যবান কাহিনি র ও অবতারণা করেন । লাউসেন হাকন্দে যাবার সময় ভাবে যে সে ফিরে নাও আসতে পারে। তাই পরিবারের জন্য চিন্তিত হয়ে ধর্মরাজকে স্মরণ করে। ধর্মরাজ যেন তার স্ত্রী, পরিবার ও রাজ্য রক্ষা করেন। এই অনুষঙ্গে গান ' তুমি নিত্য নিরঞ্জন প্রেম নিকেতন জয় জয় প্রেম হরে.....' লাউসেনের হাকন্দে যাওয়ার পথ বর্ণনা করে গায়েন ভাটিয়ালি সুরে গান ধরে ' একবার চলো রে নৌকা......চলো রে মাঝি রে....... ওরে মাঝি রে....ওরে মাঝি রে। যেহেতু এই কাব্যে নায়ক চরিত্র লাউসেন তাই বেশির ভাগ গান তার ই মুখে বসানো হয়েছে। লাউসেন ধর্ম রাজের কাছে পশ্চিম উদয়ের জন্য প্রার্থনা করে । গায়েন এই অনুষঙ্গে গান ধরে ' নারায়ণ কৃপা করে দাও দরশণ'। এখানে ধর্মরাজ সূর্য দেবতা। লাউসেন কঠোর তপস্যা করেও যখন সূর্য পশ্চিমে উদয় হল না তখন লাউসেন নিজের প্রাণ ত্যাগ করে দেহ কে নটা খন্ড করে। এই দেহ খন্ড করার আগে গান ' এখনো নেভেনি হুমের আগুন আসিছে ধৃপেরো গন্ধ। তবে কেন তোমার মন্দির দ্বার করিলে এখন ই বন্ধ ।। বহু দূর হতে এসেছি ছুটিয়া তবে চরণ দুটি পাব গো বলিয়া ।দাও না দাও না চরণে ঠেলিয়া কপাল হয়েছে মন্দ।।।' প্রাত্যহিক জীবনে ক্লেদ নাশের জন্য এই ধর্ম পুরাণ শোনানো হয় । এলাকার মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সকল এলাকাবাসী ই এই পাঠ শুনতে আসেন। ধর্ম পুরাণ পাঠের উদ্দেশ্য আমার মতে ১ ] লোক শিক্ষা , ২] লোক বিশ্বাস ৩]লোক নাটক ৪]লোক সংস্কৃতি ধর্মপুরাণ পাঠ কালে গায়েন শুধু গাইছে না। রঞ্জাবতীর পুত্র না হবার শোকে , অমলা বিমলা স্বামী হারানোর আশঙ্কায় , লাউ সেনের প্রাণ ত্যাগের পালা বর্ণনা করার সময় কেঁদে ও ফেলছেন। অর্থাৎ একটা নাটকীয় তা ও আছে পরিবেশনে। মূল গায়েন সহ যন্ত্রানুষঙ্গে যাঁরা আছেন তারা সকলেই বিশেষ পোশাক পরেছেন। মূল গায়েন খুবই সুন্দর উজ্জ্বল পোশাকের সাথে পা পর্যন্ত রজনীগন্ধার মালা পরেছেন।ধর্মপুরাণ শুনতে আসা সকল গ্রামবাসী তাঁকে প্রণাম করে প্রণামী দিচ্ছেন । আশাবরী মাথায় বুলিয়ে সকলকে আশীর্বাদ ও দিচ্ছে গায়েন। অর্থাৎ তিনি ই তখন ধর্ম রাজের প্রতিভূ। শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ এরা। চাষবাস, মাঠে ঘাটে বাগাল খাটা জোগাড় খাটা মানুষ গুলি কিছু সময়ের জন্য ঈশ্বর হয়ে ওঠেন । তাদের পূর্বপুরুষ সূত্রে শেখা গান গুলো র ভাষা আধুনিক । শুনলে কোনো টা নজরুল গীতি আবার কোনো টা ভাটিয়ালি আদলে । তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে সুর নকল করা, তবু ও এই প্রান্তিক মানুষগুলির দক্ষতা মুগ্ধ করে। কারণ বিষয়, ঘটনা , সময়, কথা, সুর , রাগ, রাগিনী সঙ্গতি রেখেছেন। ধর্মের গাজন:_ ধর্মপুজার প্রধান পীঠস্থান বর্ধমান জেলা। বর্ধমান জেলার মাঝখান দিয়ে বহে গেছে দামোদর নদ। ধর্ম ঠাকুরের উপাসকদের কাছে এই নদ গঙ্গার মতোই পবিত্র । ধর্ম ঠাকুরের কামিনী মনসার ও প্রধান পীঠস্থান বর্ধমান জেলা। এই সব গ্রামদেব ও দেবীদের নিয়ে ই গড়ে উঠেছে এখানকার লোক সংস্কৃতি । ধর্ম ঠাকুরের পুজো উপলক্ষে ধর্মের গাজন ও এই লোক সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ ।এই গাজন উপলক্ষে গাজন পালা গাওয়া হয়। গাজন পালার বিষয় পারিবারিক কেচ্ছা কাহিনি থেকে শুরু করে বিদেশী শাসন, শোষন ও বিশ্লেষণ ও হতে পারে। যে কোনো দলে একজন করে ম্যানেজার থাকেন। মূল গায়েন গান গুলি লেখেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ও গাজন পালা লিখতে পারেন। এমন ও দেখা গেছে । অর্থাৎ বোঝাতে চাইছি এটি অসাম্প্রদায়িক । তাই বলা যায় গাজন পালা হল সাধারণের বিনোদনের জন্য সাধারণের তৈরি গান বা বলতে পারি লোকায়ত মানুষের বিনোদনের জন্য তাদের ই সৃষ্ট গান। ধর্মের গাজনের পালা বলতে কিন্তু ধর্ম পুরাণ ই বোঝায়। যা পূর্বে ই বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিনয় ঘোষের লেখা পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতিতে ( ৪খন্ড) বলা হয়েছে গর্জন শব্দ থেকে গাজন শব্দ এসেছে। গাজন উৎসবের মধ্যে মহাদেব শিব অথবা ধর্ম নিরঞ্জন কে বাববার ডাকা যেন গর্জনের মতো শোনায়। তবে এই গর্জন অবশ্যই গাজনের বৈশিষ্ট্য নয়। গাজন আসলে গীতিনাট্যের আদলে রচিত পালাগান।এককথায় লোকশিক্ষার জন্য লোক নাটক একথা আমরা বলতে পারি। ধর্মঠাকুর নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে পুজো পেত। সাধারণত ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো করে । পুরোহিত পৈতে পরে না । তামার তাগা পরে হাতে। নিম্ন বর্ণের মানুষ সর্বদা উচ্চ বর্ণের মানুষের কাছে অত্যাচারিত হয়েছে সব কালেই। তাই এই গাজন এই সব উৎসবের মধ্যে দিয়ে তাদের বিশ্বাস, জীবন বোধ , সংস্কৃতি কে তুলে ধরতে চেয়েছে। ধর্মের গাজন এখন শিবের গাজনে পরিণত হয়েছে। কারণ একটাই । অচ্ছুৎ থেকে একটু উচ্চ মর্যাদা পাওয়া । যাতে গ্রামের সমস্ত শ্রেণীর মানুষ যোগদান করে। ধর্ম ঠাকুরের গায়ে অচ্ছুৎ যতটা লেগে আছে শিবের গায়ে সেটা নেই । ধর্মের গাজন দেখতে আমি পৌঁছেছিলাম বর্ধমান জেলার খন্ডঘোঘ থানার অন্তর্গত সগড়াই গ্রামে । সঙ্গে লোক গবেষক গৌরীশংকর দাস মহাশয় ছিলেন। সগড়াই গ্রামের অনতিদূরে কৃষ্ণপুর গ্রাম । কৃষ্ণপুরেই ধর্ম মঙ্গল কাব্যের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী র জন্ম । প্রতি বছর মাঘ মাসে কবির জন্মদিবস উপলক্ষে ঘনরাম মেলা বসে এই গ্রামে । ধর্ম মঙ্গল কাব্যের আলোচনা , কবিতা পাঠ সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ঘনরাম স্মৃতি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। যাই হোক এই মেলাতে বিগত কয়েক বছর ধরে অংশ গ্রহণ করার সূত্রে সগড়াই গ্রামে ধর্ম রাজের গাজন দেখার আমন্ত্রণ পাই। সকাল 10.30পৌছেে দেখি ধর্ম পুরাণ পাঠের শুরু হয়ে গেছে। ধর্ম রাজ এখানে কুর্ম অবতার রূপে পুজিত। চারচৌকো কালো শিলাখন্ডের পাশে কালো পাথরের কচ্ছপ ও আছে। এই গ্রামে ধর্ম রাজের নাম বাঁকুড়া রায় । দেবী মনসার নাম কামিন্যা। ধর্ম রাজ ও দেবী মনসার বিয়ে উপলক্ষে এখানে দ্বাদশ দিনের গাজন অনুষ্ঠিত হয় । মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত নন্দদুলাল পন্ডিত ও ভোলানাথ পন্ডিত পুজো র ব্যস্ততার মধ্যে ও আমাদের মূর্তি দর্শন করিয়ে বুঝিয়ে বলেন এসব কথা। ধর্ম রাজের মাথায় রূপোর ছাতা দেখিয়ে বলেন ধর্মের ছাতা ।মূর্তির পাশে কতকগুলি মাটির ঘোড়া ও আছে। তিনি বলেন এগুলো সূর্যের ঘোড়া।এই পুরোহিত মশাই শোবার সম্প্রদায়ের মানুষ বলে তিনি নিজেই জানান। দ্বাদশ দিনের গাজনের মূল আকর্ষণ ধর্মপুরাণ পাঠ । গ্রামের সমস্ত মানুষ মহিলা, পুরুষ, বাচ্ছা সকলেই মন্দির প্রাঙ্গণে বসে মন দিয়ে শুনছেন। গাজনের সন্ন্যাসী একটা বিশেষ ব্যপার। এই গ্রামে গাজনের যারা সন্ন্যাসী তারা টানা আটচল্লিশ ঘন্টা উপবাসী থাকেন। তার ও আগে একদিন হবিষ্যি করে ও একদিন ফল খেয়ে তারা সংযম পালন করেন। গ্রামের পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ সব বয়সের অন্তত তিরিশ জন পুরুষ সন্ন্যাসী হয়েছেন দেখলাম । সন্ন্যাসীরা সকলে ধুতি, গায়ে গামছা ও বেতের ছড়ির মতো হাতে নিয়ে আছেন। ধর্ম পুরাণ পাঠ কালে সকল সন্ন্যাসী মন্দিরে উপস্থিত থাকেন। ধর্ম মঙ্গল কাব্যের পশ্চিম উদয় পালায় যখন লাউসেন তপস্যা করেও সূর্য পশ্চিম উদয় হল না তখন লাউসেন নিজের দেহ ন টুকরো করে প্রাণ আহুতি দেন। এই পালা শোনার সময় সন্ন্যাসী রা সকলে শব দেহের মতো লম্বা হয়ে শরীর ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। পালা বর্ণনা শেষ হলে আবার যেমন ধর্ম রাজের কৃপায় লাউসেন জীবন ফিরে পায় সেই অনুসরণে পুরোহিত ঘটের জল ছিটিয়ে তাঁদের জীবন দান করেন। সন্ন্যাসীরা সকলে তখন উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে তারপর স্নান করতে যান। গ্রামের সকল মহিলারা ধর্ম রাজের থানে পুজো দিতে আসেন। ফল, মিষ্টি, ফুল , ধূপ সহ চাল আলু, পটল, টমেটো , বেগুন এমনকি সজনের ডাঁটা ও দিয়ে যান। শুনেছি কোথাও কোথাও মান কচু ও পুজোতে দেওয়া হয়। হবিষ্যি, ফল, রাত গাজন, দিন গাজন , ভোজ এই ভাবে কয়েকদিন এখানে গাজন অনুষ্ঠান পালন করা হয়। রাত গাজনের দিন ধর্ম রাজের বিয়ে হয় দেবী মনসার সাথে। পরের দিনকে বলে দিন গাজন । এই দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে সন্ন্যাসীদের শালে ভর দেওয়া ।ধর্ম মঙ্গল কাব্যে রঞ্জাবতী শালে ভর পালা বর্ণিত আছে। রঞ্জাবতী চাঁপাই এর ঘাটে গিয়ে পুত্র কামনায় ধর্ম রাজের কঠোর তপস্যা করে। এবং যাগযজ্ঞ করে একটি বড়ো শাল অর্থ শূলে ঝাঁপ দেয় । বুকে পিঠে ফুটে শাল পিঠে হল ফার। ঝলকের ঝলকের মুখে উঠে রক্তধার।। ঠিক এই পালার অনুসরণ করতে দেখলাম সগড়াই গ্রামে । গাজনের সন্ন্যাসীরা পিঠে বড়শি গাঁথেন, কোথাও জিভে বড়শি গেঁথে ঘোরেন। এই গ্রামে দুটি শাল আছে। একটি বড়। একটি একটু ছোট। শাল গুলিতে হলুদ মাখিয়ে, সিঁদুরের ফোটা দিয়ে পুজো করে রাখা থাকে। দিন গাজনের দিন শাল দুটি সন্ন্যাসী রা কাঁধে করে নিয়ে পুকুরে যায় । ধর্ম ঠাকুরকে পালকিতে করে পুকুর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে সন্ন্যাসীরা সকলে গলায় নিমপাতা, আকন্দ ফুল, কাঁচা খেজুরের মালা পরেন। গাজনের মূল সন্ন্যাসী বড় শৃলে চড়েন। মানসিক করেন যে সন্ন্যাসী তিনি ছোট শূলে চাপেন। শৃলের বড় বড় কাঁটা তাদের গায়ে ফুটে গেঁথে যায় । ঐ শূল বিদ্ধ অবস্থাতেই কাঁধে করে শব দেহের মতো অন্যান্য সন্ন্যাসীরা তুলে নিয়ে মন্দিরে যায় । মন্দিরে গিয়ে শাল থেকে উঠে তারা উপবাস ভঙ্গ করেন। বিশালাকার শাল টি ঐ গ্রামের তৈরি নয়।দামোদরের জলে ভেসে এসেছে বলে গ্রামবাসীদের কাছে জানতে পারি। তাদের বিশ্বাস এই শাল ধর্ম মঙ্গলে বর্ণিত সেই শাল ই নদীতে ভেসে এসেছে। পরের দিন ভোজ অনুষ্ঠান । মন্দিরের পুরোহিত নন্দদুলাল পন্ডিত বলেন ধর্ম রাজ ও মনসার বিয়ে উপলক্ষে প্রীতিভোজ । প্রীতি ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি বিবাহপত্র হাতে দেন। গীতার শ্লোক যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত...... দিয়ে পত্র টি শুরু। এই পত্র থেকে জানা যায় যে হুগলি জেলার উওর পাড়ার মুখোপাধ্যায়ের বংশজাত জমিদাররা এই গ্রামে ধর্ম পুজো র প্রচলন করেন। ১৩৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে সেই থেকেই এই পুজো চলে আসছে। বিবাহ পত্রের কয়েকটি লাইন তুলে উল্লেখ করলাম _ প্রতি বর্ষে ধর্ম্ম বিয়ে মনসা মিলন, দেখিতেছি গ্রামবাসী যাবজ্জীবন । কত হবে কত যাবে তুমিতো থাকিবে, মুখোঃ বংশের এ সুকীর্তি জগত ঘষিবে।। সগড়াই গ্রামবাসী তব আশীর্বাদে, কাটায় জীবন যেন সবে নিরাপদে। তোমার বিবাহ হয় দোলের গাজনে, বর্ষে বর্ষে বিধাতাব্যং মনসা মিলনে ।। এতদূরে উপহার করি সমাপন, শ্রীচরণে মনপ্রাণ করি সমর্পণ । আগামী বর্ষের তরে রহিনু আশায় , মতি গতি রহে যেন ঐ রাঙা পায়।। প্রীতি ভোজে আশে পাশের গ্রামের পনের হাজার মানুষ আমন্ত্রিত হয়েছে। বিশালাকার প্রায় তিরিশ টি উনুন তৈরি হয়ছে। রাত বারো টা থেকে ই রান্না শুরু হয়। আহার সামগ্রীর পরিমাণ এত বেশি যে কোনো পাত্রে রাখা সম্ভব নয়। বড় বড় পাকা চৌবাচ্চা তৈরি করা আছে। তাতেই ঢালা হয়। স্তুপাকৃতি কুমড়ো, বাঁধাকপি, পুঁইশাক, পটল , সহ রান্না র বিরাট আয়োজন করা হয় গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে । গাজন উপলক্ষে মেলা ও বসে। কাঁচের চুড়ি, হার কানের, বাচ্ছাদের পুতুল, ঝুমঝুমি, ব্যটবল, রান্নাবাতি , খেলনা গাড়ি ইত্যাদি পসরা সাজিয়ে বসেছে কিছু ব্যবসায়ী । দোলের সময় অনুষ্ঠিত এই গাজন সগড়াই বাসিদের কাছে খুবই আনন্দের। আমরাও এই গাজনে সামিল হয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ সেরে ফিরলাম । সাক্ষী থাকলাম এই সংস্কৃতির। যা একান্ত ভাবেই এই অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির অংশ ।

read more
            
শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া!!
...
সুমনা বোস

সুমনা বোস কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায় বহুজনপদের গৌরব। কিন্তু শিল্প , সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে সেইসব অঞ্চলের অনেক ঘটনা, ও ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না কখনোই । সেই রকমই একটি জনপদ হল বর্ধমানের কাঞ্চননগর। গৌরব ময় অতীত ইতিহাসের ভাঙাচোরা টুকরো স্মৃতি বুকে আঁকড়ে রেখেছে দামোদর তীরের এই জনপদ। একসময় ছুরি কাঁচি তৈরিতে পৃথিবী বিখ্যাত ছিল এই কাঞ্চননগর ।রাঢের কেন্দ্রভূমি এই বর্ধমানকেও দ্বিতীয় বৃন্দাবন বলা হত । রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র "বিদ্যাসুন্দর "কাব্যে বর্ধমান শহর সম্পর্কে বলেছেন _ "দেখি পুরী বর্ধমান সুন্দর চৌদিকে চান ধন্য গৌড় যে দেশে এ দেশ রাজা বড়ো ভাগ্যধর কাছে নদ দামোদর ভালো বটে জানিনু বিশেষ ।" এই বর্ধমান শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত কাঞ্চন নগর। অতীতে কাঞ্চন নগর বিশেষ সম্বৃদ্ধশালী ছিল । অনেক গবেষকদের মতে কাঞ্চননগর ই ছিল কর্ণসুবর্ণের রাজধানী। আন্তর্জাতিক বাজারে এখানকার ছুরি কাঁচির প্রচুর চাহিদা ছিল। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্প নগরী শেফিল্ড এর সাথে তুলনা করে কাঞ্চন নগর কে বলা হত 'শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া '। কাঞ্চন নগরে প্রথম যিনি ছুরি কাঁচি তৈরি করেন তাঁর নাম প্রেম চাঁদ মিস্ত্রি। শুধু ছুরি কাঁচি নয়। এখানে তৈরি হত তরবারি ও। লোক মুখে প্রচলিত আছে যে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারি র যোগান দিয়েছিল কাঞ্চন নগরের এই কামারশালা গুলিই। বর্ধমান রাজ পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বর্ধমানের অন্তর্গত কামারপাড়া গ্রামের এক কর্মকার একখানি তরবারি তৈরি করে রাজবাড়ী গিয়ে দারোয়ানের হাত দিয়ে রাজা কীর্তিচাঁদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কর্মকারের ধারণা ছিল একমাত্র দক্ষ প্রশাসক, রাজা কীর্তি চাঁদের হাতেই এই তরবারি শোভা পাবে। কিন্তু রাজা সেই তরবারি পরীক্ষা করে না করেই কর্মকারকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। কর্মকার দুঃখিত হয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে সে বলে যায় যে তিনদিনের মধ্যে রাজা এই তরবারি র গুণের পরিচয় পাবেন। তিনদিন পর রাজবাড়ী র প্রধান ফটকের সামনে একটি প্রকান্ড গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায় । রাজকর্মচারীরা অনুসন্ধান করে দেখে যে গাছ টি এক কোপে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। রাজা কীর্তি চাঁদ তখন বুঝতে যে সেই কর্মকারের তরবারির আঘাতেই এটি ঘটেছে। তখন তিনি ঐ কর্মকারকে ডেকে উচিত মূল্য দিয়ে তরবারি টি ক্রয় করে ছিলেন। কিছু নিষ্কর জমিও দান করেছিলেন যাতে তার সারাজীবন অতিবাহিত হতে পারে। সেই সঙ্গে আদেশ দিয়েছিলেন যে আর যেন ঐরূপ তরবারি সে না বানায়। এই কর্মকারের ও আদি বাসভূমি কাঞ্চননগর ই ছিল বলে জানা যায় । ইতিহাসের পাতায় লেখা সেই সব গৌরবগাথার সত্যতা প্রত্যক্ষ করতে পৌঁছেছিলাম কাঞ্চন নগরে । কিন্তু হায়! বর্তমানে সেসব গৌরবের চিহ্ন মাত্র নেই । পড়ে আছে জীর্ণ ভগ্নাবশেষ।দেখা হল মলয় কুমার কর্মকার ও চন্দন কুমার কর্ম কারের সাথে ।তাদের কথায় বাবা বংশগোপাল কর্মকার ভালো কারিগর ছিলেন। এখন বাজারে চাহিদা নেই ।সস্তা ছুরি কাঁচিতে বাজার ছেয়ে গেছে । আগের মতো উন্নত মানের লোহা ও পাওয়া যায় না । তাই আগের মতো সুক্ষ কাজও আর হয় না। দীর্ঘদিন এসব কাজ না করার ফলে কারিগররাও তাদের দক্ষতা হারাচ্ছেন। নতুন জিনিস আর তৈরি হয় না। পুরনো জিনিস শান দেওয়াটুকু হয় মাত্র । কামার শালে হাপর নেই ! গনগনে আগুন নেই ! নেই হাতুরির পিটুনি ! পড়ে আছে কয়েকটি যন্ত্রপাতি আর শান দেওয়ার জন্য একটি মেশিন। যে কয়েক ঘর কর্মকার এখনো এই অঞ্চলে আছেন , জীবন যাপনের তাগিদে তারা প্রত্যেকেই অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন । পড়ে আছে লোহার বড়ো গেট। চালহীন পরিত্যক্ত বিরাট চালাঘর একসময়ের কর্ম ব্যস্ততার নীরব সাক্ষ্য দান করছে।একশোজন কর্মকার একসাথে কাজ করতেন এই কামার শালে।কথায় কথায় মলয় কুমার কর্মকার বললেন যে এক বালতি জলে এক গাছা চুল ভেসে থাকা অবস্থায় খুর দিয়ে কাটা যেত, এমন তীক্ষ্ম ও সুক্ষ কাজ হত এখানে। অতীত গৌরবের কথা মনে করে বর্তমান প্রজন্মের মুখে আজও প্রচ্ছন্ন গর্বের স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে একটু আক্ষেপ । বাপ ঠাকুরদারা যদি সেই সময় একটা সার্টিফিকেট বের করে রাখত! একটা স্বীকৃতি তো থাকত! কিছুই নেই! লোক গবেষক গৌরীশংকর দাস মহাশয় কথা প্রসঙ্গে জানান যে শুধু ছুরি কাঁচি ই নয় একসময় এই অঞ্চলে উন্নতমানের রেশম শিল্প ও গড়ে উঠেছিল। সুদক্ষ তাঁত শিল্পীরা অতি সুক্ষ রেশম বস্ত্র তৈরি করতেন ।যা রাজপরিবারের অতিথিদের উপহার হিসেব দেওয়া হত। এছাড়া ও কাঞ্চন নগর ছিল পোড়া মাটির শিল্পে সম্বৃদ্ধ অঞ্চল। প্রাচীন মন্দিরের গায়ে পোড়া মাটির কারুকার্য এখনো তার নিদর্শন হিসেবে দেখা যায় । অনতিদূরে দামোদর। বছর বছর বন্যা হত । হয়তো অনেক ঐতিহ্য ঐ বন্যার জলে ভেসে গেছে ! শিল্পী রা অনেক ই ভিটে মাটি ছেড়ে অন্য কোথাও অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন! পরম্পরা নেই । ঐতিহ্যের ছাপ টুকু পড়ে আছে। জানি না কোনো সংরক্ষণ বা পুনরুজ্জীবনের দ্বারা এই কাঞ্চন নগর কে আবার শিল্প নগরীতে পরিণত করা যাবে কি না । তবে 'শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া' র অলি গলি ঘুরতে অতীত গৌরব মনে করতে নিজেদের ও গৌরবান্বিত মনে হয়। হয় না কি !!!!

read more