156
thumb Captured By: রাজীব মুখার্জি
              • 19-04-2022   7:51 PM •      Captured By: রাজীব মুখার্জি   156

পল্টন সেতুর ইতিকথা। মাঝ বরাবর খুলে যেত সেতু। সেতু বানিয়েও লাভ করেছিল ইংরেজরা।

রাজিব মুখার্জি: হাওড়া:ব্রিটিশরা পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কয়েক দশক পরে কলকাতাকে ভারতের রাজধানী ঘোষণা করেছিল। ব্রিটিশ তথ্য অনুসারে ১৭৭২-১৯১২ সাল অব্দি কলকাতাই ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসাবে ছিল। আর দেশের রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতার উন্নয়নে বৃটিশদের বিশেষ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল।

কলকাতা থেকে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম ছিল গঙ্গা। তবে গঙ্গা পারাপার করার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল ইংরেজ প্রশাসনকে। গঙ্গার নাব্যতা অধিক থাকার কারণে বড় জাহাজও কলকাতা ও হাওড়ার মাঝে গঙ্গার জলপথ ধরে অবাধেই যাতায়াত করতে পারত। তবে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে হাওড়া ও কলকাতা যাতায়াতের সমস্যা ছিল যথেষ্টই।

সেই সমস্যা সমাধানের জন্য ইংরেজরা তৈরি করেছিল দুটি সেতু প্রথম সেতুর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে সময় লেগেছিল ১৯ বছর পাশাপাশি নতুন হাওড়া সেতু নির্মাণে ৩০ বছর সময় লেগেছিল যদিও ইংরেজরা সেতু নির্মাণে " ধীরে চলো" নীতি নিয়েই এগিয়েছিল তবে সেতু যে আগে ছিল না তেমন নয় সেই সেতু পরিচিত ছিল ভাসমান সেতু নামে সারি সারি নৌকা একসঙ্গে বেঁধে তার উপরে পাটাতন পেতে তৈরি হয়েছিল এই ভাসমান সেতু এতে ছিল জাহাজ ও স্টিমার চলাচলের সময় সেতুর মাঝ বরাবর থেকে দড়ি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা এই সেতু লম্বায় ১৫২৮ ফুট ও চওড়ায় ছিল ৪৮ ফুট চলাচলের জন্য সেতুর দুই পাশে সাত ফুটের থাকতো ফুটপাত পাশাপাশি জাহাজ ও স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া হত স্টিমার এলেই সেতু বন্ধ করে দেওয়া হত স্টিমার চলে গেলে আবার খুলে দেওয়া হতো সেতু এই পুরনো হাওড়া ব্রিজের নকশা বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতে রেল কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার স্যর ব্র্যাডফোর্ড লেসলি নদীর দু’পাড়েই জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজদের কারবার ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন কারখানা তাই হাওড়া-কলকাতার জন্য একটি সেতু এ বার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো ইংরেজরা ইংরেজ প্রশাসন ১৮৫৫-৫৬ সালে প্রথম একটা সেতুর কথা ভেবেছিল সেই মর্মে তৈরি হয়েছিল কমিটিও তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বছর চারেক পর ১৮৫৯-৬০ সালে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব স্থগিদ করে দেয় ইংরেজ সরকার এরপর আবার আট বছর পর সেই স্থগিদ রাখা ফাইল আবার বাইরে আনা হয় ত়ৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সেতু নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে রাখার সিদ্ধান্ত নেনতবে সেটি থেকে অর্থ তোলার পরিকল্পনা করে ১৮৭১ সালে তৈরি হয় ‘হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ তারপর থেকেই সেতু পেরোতে কর দিতে হত করে টাকাতেই চলত সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ১৮৭১-এ আইন হওয়ার পর রেল কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার স্যর লেসলিকেই সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয় তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে সেতুর ডেক এবং ভাসমান সমতল ‘নৌকা’ বানানোর কাজ শুরু করালেন জাহাজে করে সেই মাল এসে পৌঁছল কলকাতা নৌবন্দরে তার পরে একে একে সমতল নৌকার উপর পর পর ডেকগুলি জুড়ে তৈরি হল প্রথম হাওড়া ব্রিজ মাঝের ২০০ ফুট খোলার ব্যবস্থাও রইল ১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেই সেতু অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন যা পরিকল্পনা রূপায়িত হয়েছিল ১৯ বছর পর তবে এই সেতু নির্মাণ করার জন্য লেসলি সাহেবের সংস্থাকে দিতে হয়েছিল তৎকালীন বাজারদর অনুযায়ী ২২ লক্ষ টাকা তবে নতুন হাওড়া সেতু তৈরির আগে অব্ধি ওই ভাসমান সেতু থেকে সর্বমোট কর আদায় হয়েছিল ৩৪ লক্ষ ১১ হাজার টাকা সুতরাং সেতু থেকেও লাভ করেছিল ইংরেজ প্রশাসন বছরে কমপক্ষে দেড় লক্ষ টাকা টোল আদায় হয়েছিল সে সময় তবে ভাসমান সেতুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাহাজ-স্টিমার যাতায়াতের ব্যবস্থা করা জাহাজ গেলেই সেতু বন্ধ হয়ে যেত যানজটের বহরও বাড়ত দিনের বেশির ভাগ সময় কারণ, দিনের বেলাতেই কেবলমাত্র সেতু খোলা যেত এই ব্যবস্থা চলে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তার পর রাতেও জাহাজের জন্য সেতু খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় তাতে আগে যেখানে দিনে ২৪ বার সেতু খুলতে হত, তা কমে যায় দিনে মাত্র চার বার সেতু খুললেই কাজ মিটে যেত বন্দর কর্তৃপক্ষের নথিপত্র বলছে, ১৯০৭-০৮ সালে হাওড়া ব্রিজের মাঝখান দিয়ে ৩০২০টি জাহাজ,স্টিমার ও লঞ্চ গিয়েছিল তবে রাতে জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা চালু হওয়াতে যানজটের সমাধান হচ্ছিল না ফলে সে সময় থেকেই হাওড়াতে একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে ইংরেজ প্রশাসন এরই মধ্যে নতুন এক সমস্যার উদয় হয় তা হল হাওড়া ব্রিজের উপর গরুর গাড়ির দাপট এই বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের নথি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ১৯০৭ সালের ২৭ অগস্ট সেতু দিয়ে ১৩টি গাড়ি চললে তার আটটিই গরুর গাড়ি! পন্টুন ব্রিজ চওড়া ছিল ৪৮ ফুট তবে গাড়ি চলাচলের জন্য ৪৩ ফুটের বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছিল না অন্য দিকে ক্রমবর্ধমান গরুর গাড়ির প্রবল চাপে নাজেহাল হচ্ছিলেন বন্দর কমিশনার তিনিই তার উদ্যোগে বৈঠক ডেকে নতুন সেতুর প্রস্তাবনা করেন তৈরি হয় একটি কমিটি বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন স্কট, পূর্ব রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হাইট এবং কলকাতা পুরসভার চিফ ইঞ্জিনিয়ার ম্যাককেব ওই কমিটির সদস্য হন ভাবনা শুরু হয়, ভাসমান সেতুর বদলে একটি ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের এই পরিকল্পনা মোটেই পছন্দ হয়নি স্যর লেসলির কারণ, তখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে তিনটি মাত্র ক্যান্টিলিভার সেতু বানানো হয়েছে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ভারতে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাননি তিনি এর মধ্যেই ১৯১৭ সালে ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তিতে তৈরি কানাডার পঁ দ্য কেবেক সেতু ভেঙে পড়েছিল লেসলি সাহেব নতুন একটি ভাসমান সেতুর পক্ষেই মত দিয়েছিলেন একই মতামত ছিল পোর্ট কমিশনারেরও কারণ, বন্দরের কাছে সেতুতে গরুর গাড়ি চলাচলের চেয়ে বিলেত থেকে আসা জাহাজ চলাচল আরও বেশি জরুরি ছিল সেই শুরু বিতর্কের নতুন সেতু কোথায় হবে, কোন প্রযুক্তিতে হবে, সেতু নির্মাণের সময় যান চলাচলের সমস্যা মিটবে কী ভাবে, ইত্যাদি বিভিন্ন সরকারি নথি বলছে, তৎকালীন ইঞ্জিনিয়াররা তর্ক-বিতর্ক করেছেন সরকারি নথিতে তা লিপিবদ্ধ হয়েছে ব্রিটিশ প্রশাসন কখনও কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি প্রায় ২০-২২ বছর চর্চার পরও যখন ইঞ্জিনিয়াররা সহমত হতে পারেননি, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন তার পরে সেই কমিটির সিদ্ধান্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়ে নতুন সেতুর পরিকল্পনা-নকশা তৈরি হয় এরপর ১৯৪২ সালে নতুন হাওড়া ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের পর খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য সেই সময় থেকে চির বিদায় নেয় গঙ্গার উপরে থাকা ওই পুরানো ভাসমান সেতুটিও